Image description

ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার সূচনা আকাশপথে নয়, এর শুরুটা হয়েছিল স্থলপথ ধরে। হামলা শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিবেদনে সেরকমই ইঙ্গিত মিলেছে। এ হামলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইসরায়েল। প্রস্তুতির ভিত্তি ছিল গভীর গোয়েন্দা তথ্য ও ইরানে অপারেশনাল অনুপ্রবেশ। ইরানের কর্মকর্তারা সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীতে ইসরায়েলি অনুপ্রবেশের বিষয়ে অবশ্য আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে পুরো ঘটনায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভূমিকা কতটা ছিল, তা অনুমান করা সহজ নয়। ইসরায়েল সাধারণত মোসাদের কার্যক্রম নিয়ে মন্তব্য করে না। 

 

ইরানের ভেতরে মোসাদের অস্ত্র উৎপাদন

ইসরায়েলি ও পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিষয়টা শুধু ইরানের সংবেদনশীল তথ্য অবধি পৌঁছানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এ প্রতিবেদনগুলো এও ইঙ্গিত করে যে, ইরানের মাটিতে আক্রমণাত্মক অস্ত্র তৈরি ও মোতায়েনের জন্য একটা সংগঠিত ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছিল ইসরায়েল। স্থানীয় এজেন্টদের নেটওয়ার্ক, তাদের জন্য কভারের (এজেন্টদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য) ব্যবস্থা করা, পরিবহনব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ গোপন কর্মকাণ্ড দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে বলে অভিযোগ। আর এ প্রস্তুতির ভিত্তিতেই সাম্প্রতিক হামলার ভিত্তি স্থাপন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সামরিকবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার জোন’ এবং অন্যান্য সূত্রের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, ইরাকের মধ্য দিয়ে যাওয়া ট্রাক, বাণিজ্যিক কন্টেইনার এবং যাত্রী স্যুটকেসের মধ্যে বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে রেখে ইরানে অল্প অল্প করে সংবেদনশীল ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র সরঞ্জামের চোরাচালান করেছে ইসরায়েল। এ ডিভাইসগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক ফিউজ, উন্নত ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ক্যামেরা, লিথিয়াম ব্যাটারি, হালকা ওজনের ইঞ্জিন, জিপিএস-ভিত্তিক গাইডেন্স সিস্টেম এবং সুরক্ষিত যোগাযোগ ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব যন্ত্রাংশ পরে ইরানের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা মোসাদের গোপন ঘাঁটিতে নিয়ে গিয়ে একত্রিত করে তাকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রের আকার দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন ডেরা তৈরি করেছিল মোসাদের সদস্যরা।

মোসাদ সন্দেহে চলছে গ্রেপ্তার

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের পর ইরানে বেড়ে গেছে গ্রেপ্তারের সংখ্যা। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করেছে দেশটি।

দেশটির কর্মকর্তারা মনে করছেন তাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোয় ইসরায়েলি চরদের নজিরবিহীন অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ইরানের কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করছে, ইসরায়েলকে এসব চরের দেওয়া তথ্য সাম্প্রতিক সংঘাতের সময় একাধিক হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছিল। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর বা আইআরজিসির সিনিয়র কমান্ডারসহ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী। এ হত্যাকাণ্ডের মাত্রা এবং নির্ভুলতা দেখে হতবাক হয়েছে ইরানের কর্তৃপক্ষ। তাই এখন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে এমন সন্দেহভাজন যে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তারা বলছে যে, এটি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে করা হচ্ছে।

কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, এটি ভিন্নমত দমন এবং নাগরিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদারে ব্যবহার করা হতে পারে। ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। গত বুধবার যুদ্ধবিরতির ঠিক একদিন পর একই অভিযোগে আরও তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। 

কর্মকর্তারা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দেশজুড়ে শত শত সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বেশ কয়েকজন আটক ব্যক্তির কথিত স্বীকারোক্তি সম্প্রচার করেছে, যারা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছেন।

মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং কর্মীরা সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ইরানের দীর্ঘদিন ধরে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় ও অন্যায্য বিচারের চর্চা আছে। আরও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে এমন উদ্বেগও রয়েছে।

ইরানের গোয়েন্দা বিষয়ক মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে, তারা পশ্চিমা ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক; যার মধ্যে সিআইএ, মোসাদ এবং এমআই-৬ রয়েছে, এদের বিরুদ্ধে ‘নিরলস যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে।

আইআরজিসির সঙ্গে সম্পর্কিত ফার্স নিউজ এজেন্সির মতে, গত ১৩ জুন ইরানে ইসরায়েলের আক্রমণ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক দেশের অভ্যন্তরে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’ 

ফার্স জানিয়েছে, সংঘাতের ১২ দিনে ইরানি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী এ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ৭০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।

ইরানি অনেক নাগরিক বিবিসিকে জানিয়েছেন, তারা ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কীকরণ  বার্তা পেয়েছেন, যেখানে তাদের ফোন নম্বর ইসরায়েল সম্পর্কিত সোশ্যাল মিডিয়ার পেজে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের এ পেজগুলো ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অন্যথায় তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। ইরান সরকার বিবিসি, লন্ডন-ভিত্তিক ইরান ইন্টারন্যাশনাল এবং মানোতো টিভিসহ বিদেশে ফার্সি ভাষার মিডিয়া আউটলেটগুলোয় কাজ করা সাংবাদিকদের ওপরও তদারকি বাড়িয়েছে।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই নিরাপত্তা বাহিনী কয়েক ডজন কর্মী, লেখক ও শিল্পীকে আটক করেছে। ২০২২ সালের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তারের খবরও রয়েছে। এ পদক্ষেপগুলো কেবল বর্তমান অ্যাক্টিভিস্টদের টার্গেট করেই হচ্ছে না, বরং আগেও বিভিন্ন সময়ে ভিন্নমতের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধেও একটি বৃহত্তর অভিযানের ইঙ্গিত দেয়।

মানবাধিকার সমর্থক এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এ পরিস্থিতিকে ১৯৮০-এর দশকের সঙ্গে তুলনা করছেন, যখন ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরানি কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করেছিল। 

তৎপরতা অব্যাহত থাকবে মোসাদের

তবে এ গ্রেপ্তার তৎপরতা সত্ত্বেও মোসাদ অদূর ভবিষ্যতে ইরানের অভ্যন্তরে গোপন অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রাখবে বলে গত বুধবার ঘোষণা করেছেন সংস্থাটির পরিচালক ডেভিড বার্নিয়া। তিনি এগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য কৌশলগত অপরিহার্যতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এক ভিডিও বার্তায়, বার্নিয়া জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রম ব্যাপক এবং চলমান থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমরা সেখানে থাকব, যেমন আমরা সেখানে ছিলাম। আমরা সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ধরে কাজ করেছি।’ খবর বিবিসি ও জেএনএস নিউজের।