Image description
সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। সবার সাথে শুধু ছলনা হয়েছে। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনাবেচা করেছে তাদের আমি কখনো ক্ষমা করব না -উমামা ফাতেমা এনসিপির জেলা কমিটিতে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি রয়েছে, যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন :নাহিদুল ইসলাম সাজু

ঘরের আগুনে পুড়ছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ দলের নেতারাই একে অন্যের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ এনে দল থেকে পদত্যাগ করছেন। ইতিপূর্বে এ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদা বাজি, নারী কেলেঙ্কারীসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এবার এ দলের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে বাজার দরে বিক্রি করার ভয়ানক অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন প্ল্যাটফরমটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। গত ২৭ জুন শুক্রবার দিবাগত রাতে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক দীর্ঘ পোস্টে তিনি এ অভিযোগ তুলে প্ল্যাটফরম ছাড়ার ঘোষণা দেন।

উমামা ফতেমা তার পোস্টে লিখেছেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছে গত পরশু। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখানেই শেষ হলো।’ তিনি পরোক্ষভাবে এনসিপির নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর নিক্ষেপ করে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের কথা চিন্তা করে আমি এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সকল ধরনের সমর্থন ও কাউন্সিলে প্রদত্ত ভোট প্রত্যাহার করলাম। আমি অত্যন্ত অশান্তিতে আছি। অভ্যুত্থান যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছে, গোষ্ঠীস্বার্থে এই প্ল্যাটফর্ম একইভাবে বহু মানুষের স্বপ্ন ও সময় নষ্ট করেছে। আমি অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিলাম। প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার আগে আমাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে যাওয়ার পরেই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্ররাই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সবার সাথে শুধু ছলনা হয়েছে। যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার সাথে নোংরামি করেছে এতগুলা মাস, অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনাবেচা করেছে তাদের আমি কখনো ক্ষমা করব না। আমি রুহের ভেতর থেকে বদদোয়া দিচ্ছি এই মোনাফেকদের। রাজনৈতিকভাবে চাইলে অনেক সুবিধা আমি নিতে পারতাম। কিন্তু পারি নাই। আসে নাই ভেতর থেকে। অনেক বেশি মানুষ মারা গেছে আসলে। এতগুলা সন্তান এতিম হইছে, মেয়েরা বিধবা হইছে, বাবা-মা সন্তানহারা হইছে। আমি পারি নাই এসবকে পলিটিক্যালি ক্যাশ করতে।’ উমামা ফাতেমার এই পোস্ট এনসিপির নেতাদের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের আসল চেহারাকে জাতির সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জুলাই বিপ্লব সফল হওয়ার পর এই প্ল্যাটফরমের তরুণ নেতাদের কাছে জাতি অনেক বড় কিছু প্রত্যাশা করেছিল। তবে এই প্ল্যাটফরমের অনেক নিতাই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানকে ধারণ করে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এনসিপি নামক রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেয়। এরপর থেকে তাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ উত্থাপিত হতে থাকে। যার অনেকগুলো পরে সত্য বলে প্রমানীত হয়। শুরুতেই এ দলের কমিটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। গত ২মার্চ ২১৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে দলটি। এনসিপির এই কমিটি নিয়ে চলে নানান আলোচনা সমালোচনা। অনেকেই বলেন, এই কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন তার মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বেশি ছাত্র শিবিরের সাবেক নেতাকর্মী। আবার অনেকে এই কমিটিতে নিষিদ্ধ ছাত্র লীগের অনেকে আছেন এমন অভিযোগ করছেন। এ ছাড়া এতে সরকারী চাকরিজীবীরাও বিভিন্ন পদে রয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কাওরান বাজার শাখায় কর্মরত মনিরা শারমিন এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। আবার বেনরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এ কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ওই সময় কমিটিতে কাঙ্খিত পদ না পেয়ে দল থেকে পদত্যাগ করেন যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবু হানিফ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তর অঞ্চল) হানিফ খান সজিব ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুজ জাহের। যদিও তারা তখন ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। বর্তমান এনসিপির নেতাদের একসময় নেতা ছিলেন গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। সেই নুরও তখনএনসিপির নেতাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং প্রলোভন দেখিয়ে নেতাকর্মীদের দলে নেওয়ার অভিযোগ করেন। গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর অভিযোগ করেন ‘১০ কোটি টাকা’ ও ‘এমপি’ (সংসদ সদস্য) করার প্রলোভন দেখিয়ে তার দলের ২০ জন নেতাকর্মীকে এনসিপিতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্য, টেন্ডারবাজিরও তখন অনেক অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের নানান আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই এক নারী সদস্য দলের এক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেন। সম্প্রতি এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষারের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেন দলটির কেন্দ্রীয় এক নারী সদস্য নীলা ই¯্রাফিল। এরপর তার অভিযোগের ভিত্তিতে তুষারের পদ স্থগিত করা হয়। কিছুদিন আগে পুলিশকে মারধর করার অভিযোগে আটক কয়েকজন কর্মীকে থানা থেকে জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হান্নান মাসুদ। এ জন্য দল থেকে তাকে পরে সতর্ক করা হয়েছে।

সর্ব শেষ এক মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী জেলা এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়কারীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে জেলার প্রধান সমন্বয়কারীরও পদত্যাগ করেন। জানা গেছে, এনসিপি রাজশাহী জেলা সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী করে রাশেদুল ইসলামকে গত ১৮ জুন জেলা সমন্বয় কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আট দিনের মাথায় গত ২৬ জুন রাতে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। ইংরেজিতে লেখা পদত্যাগপত্রের চিঠিতে রাশেদুল বলেন, ‘আমি এনসিপির রাজশাহী জেলার প্রধান সমন্বয়কারীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিচ্ছি। এনসিপির ব্যানারে দলের সেবা করা এবং দেশের উন্নতির জন্য কাজ করা আমার জন্য সম্মানের ও সৌভাগ্যের। জেলা ইউনিটের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে যে আস্থা, সমর্থন এবং সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবে ব্যক্তিগত কারণে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এই মুহূর্তে আমাকে আমার ভূমিকা থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। গত ২৫ জুন রাতে একটি রেস্তোরাঁয় বসেছিলেন জেলা কমিটির নেতারা। এই রেস্তোরাঁর মালিক রাশেদুল ইসলাম। সেখানে ১ নম্বর যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলাম সাজু আরেক যুগ্ম সমন্বয়কারী ফিরোজ আলমকে লাথি মারার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার পর আহত অবস্থায় ফিরোজকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে জেলা সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলাম সাজুকে শুক্রবার সাময়িক অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। একই সঙ্গে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।

২৭ জুন বিকেলে এক ভিডিও বার্তায় নাহিদুল ইসলাম সাজু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজশাহী জেলার আহ্বায়ক পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘এনসিপির জেলা কমিটিতে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি রয়েছে, যারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন। এর কিছু তথ্যপ্রমাণ সামনে আসায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। তার কোনো সুরাহা না হওয়ায় এটি শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার শামিল। রাজশাহীতে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার ধুম চলছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এনসিপিকে জেলায় অবাঞ্ছিত করা হবে।’ পদত্যাগের বিষয়ে রাশেদুল ইসলাম বলেন, পদত্যাগপত্র কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। আমি কোনো দিন রাজনীতি করিনি। হঠাৎ এসে মনে হচ্ছে, এত বড় পদ আমার জন্য না। তবে আমি এখনো এনসিপির সঙ্গে আছি। এনসিপির ভালোটাই চাই। একান্তই ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেছি। কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন সাংবাদিকদের বলেন, ইতোমধ্যে সবার সঙ্গে কথা বলেছি। সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছি। রাজশাহীতে এনসিপির কার্যক্রম আছে, সবাই মিলেই কাজ করব।

এদিকে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা এনসিপির সদ্য ঘোষিত সমন্বয় কমিটি থেকে তিন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। কমিটি গঠনের ২০ দিনের মাথায় গত২৫ জুন পীরগঞ্জ প্রেসক্লাবের হলরুমে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পদত্যাগকারী সদস্যরা হলেন তৌফিক হাসান, মোক্তাদির কেমি ও জাহাঙ্গীর আলম জাকির। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তৌফিক হাসান। তিনি বলেন, ‘গভীর ভাবনা ও পর্যবেক্ষণের পর আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, গঠিত কমিটির প্রক্রিয়া আমাদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ন্যায়বোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ কারণে আমরা এই কমিটি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ পদত্যাগের কারণ তুলে ধরে তৌফিক হাসান বলেন, ‘কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীদের মূল্যায়ন না করে উপেক্ষা করা হয়েছে।