Image description

‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ যার আরেক নামÑ শয়তানের ত্রিভূজ। আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল। যেখানে বহু জাহাজ এবং উড়োজাহাজ রহস্যজনক নিখোঁজ হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে প্রকা- কোনো বস্তু নিখোঁজ হলে আর খোঁজ মেলে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)’র ‘যাবাক’ (যাচাই-বাছাই কমিটি)-কে অনেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সঙ্গেও তুলনা করেন। ‘যাবাক’ হচ্ছে দুদক নামক প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি। গত ১৬ বছরে বৃহৎ দুর্নীতির বহু অভিযোগ যাবাকে ‘নাই’ হয়ে গেছে। সংস্থাটির তফসিলভুক্ত অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো অনুসন্ধানে যাবাক’র সুপারিশ মেলেনি। আবার তফসিলভুক্ত নয়Ñ এমন বহু অভিযোগও অনুসন্ধানের সুপারিশ পেয়েছে এই কমিটির। অভিযোগ প্রাপ্তির কোনো ডাটাবেজ নেই। অভিযোগ নিষ্পত্তিতেও নেই সতসিদ্ধ আইনি পদ্ধতি ও বিধি-বিধান। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারে যখন যে বসেছেন, তিনি নিজের মতো বাতলে নিয়েছেন ‘পদ্ধতি’। একটি অভিযোগ অনুসন্ধান-উপযোগী কিংবা দুদকের তফসিলভুক্ত না হলে অভিযোগটি কোথায় যায়, কি হয়Ñ অভিযোগকারী সেটির পরিণতি জানতে পারেন না। মামলা হলেও সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয় দু’-চারটির। ৯৭ ভাগ অভিযোগেরই শেষ পরিণতি জানা যায় না। দুদক আনুষ্ঠানিকভাবে সেসব জানায়ও না। দুদকের ‘যাবাক’ নামক বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে গত দেড় দশকে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের ‘মিথ’। মিথটি হচ্ছে, দুদকের তফসিলভুক্ত বৃহৎ দুর্নীতির ৯৮ অভিযোগই ‘যাবাক’ থেকে হাওয়া হয়ে যায়। নানামাত্রিক বোঝা-পড়ার মধ্যদিয়ে ‘যাবাক’ থেকে দায়মুক্তি পেয়ে যান দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালেরা। পক্ষান্তরে, যারা হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে দুদকে অভিযোগ দায়ের করেন, তারা দায়েরকৃত অভিযোগের পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না। উপরন্তু অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। দুদক কখনো তাদের পাশে দাঁড়ায় না। ‘সাক্ষ্য আইন’ অনুযায়ী কোনো সুরক্ষাই অভিযোগকারীরা পান না। কোনো ‘সোর্স মানি’ পাওয়ার আইনি ব্যবস্থাও নেই । গ্যারেজ বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় কয়েকস্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি। এর ভেতর সুরক্ষিত যাবাক সেল। কাচেঘেরা এই আয়না ঘরেই সম্পাদিত হয় দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই-বাছাই পর্ব। কাচ ঘিরে যতটা স্বচ্ছতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ততোটাই অস্বচ্ছতায় আচ্ছাদিত অনুবিভাগটির কর্মকা-। দুদকের নীতি নির্ধারক পর্যায় থেকে এই সেলে কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের বিষয়ে অভিজ্ঞতা নয় বরং বিশ্বস্ত ও আনুগত্যই এখানে পোস্টিং লাভের মানদ-। এ হিসেবে বিগত মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ নেতৃত্বাধীন কমিশন যাবাক’র দায়িত্ব দেন একনিষ্ঠ সিপাহসালার যুগ্ম-সচিব (মহাপরিচালক) জাকির হোসেনকে। তিনি বদলি হলে তার চেয়ারে মহাপরিচালক হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন যুগ্ম-সচিব মোতাহার হোসেন। কিন্তু মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধে ‘বিএনপি ঘরানার আমলা’র তকমা থাকায় মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহর কমিশন তাকে বিশ্বস্ত মনে করেনি। যাবাকের দায়িত্ব দেয়া মহাপরিচালক (লন্ডারিং) মোকাম্মেল হোসেনকে। তিনি এবং তৎকালীন পরিচালক উত্তম কুমার ম-ল বেশকয়েক মাস ‘যাবাক’ অনুবিভাগ পরিচালনা করেন।

দায়মুক্তি কিংবা গায়েব দুর্নীতির বৃহৎ অভিযোগ : দুদক সূত্র জানায়, যাবাকের নেতৃত্বে একজন মহাপরিচালক থাকলেও কার্যত যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি করতেন তৎকালীন পরিচালক উত্তম কুমার ম-ল। ৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই আমলাই ঠিক করতেন, কোন অভিযোগটির অনুসন্ধান হবে কোনটি গায়েব করে দিতে হবে। তার স্বাক্ষরে বহু দায়মুক্তির ঘটনাও ঘটেছে।

সূত্র মতে, হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রের অন্যতম অংশীদার এই আমলা বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর নির্বিঘেœ দুদক ত্যাগ করতে দেয়া হয়। অথচ অর্থের বিনিময়ে বহু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, অর্থ পাচারকারী প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্প পরিচালকদের নানা কৌশলে দায়মুক্তি দেয়ার অভিযোগ ছিলো উত্তম কুমার ম-লের বিরুদ্ধে। তার সময়কালে দায়মুক্তি দেয়া নথিগুলো পুনঃঅনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেয়নি ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন নেতৃত্বাধীন কমিশন।
 
দুদকের তফশিলভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বহু অভিযোগ অনুসন্ধানে না দিয়ে সরাসরি দায়মুক্তি দিয়েছেন। কোনোটি আবার কৌশলে এখতিয়ারহীন প্রতিষ্ঠানে ফেরত পাঠিয়ে অনুসন্ধান-তদন্ত থেকে বাঁচিয়ে দেন। দুদক সংশ্লিষ্টরা আশা করেছিলেন, বর্তমান কমিশন নানা কৌশলে দায়মুক্তি দেয়ার সেই নথিগুলো পুনঃযাচাই-বাছাই করবে। কিন্তু গত ৭ মাসেও বর্তমান কমিশন সেটি করতে পারেনি। হাসিনা রেজিমের বহু কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও একই সময়কালে দুদকের দুর্নীতি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ দেখায়নি।
 

মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এম.আর.পি) পাসপোর্ট প্রকল্পে পাসপোর্ট বই ক্রয় এবং মুদ্রণে ১২শ’ কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধান ধামাচাপা পড়ে আছে ইকবাল মাহমুদ কমিশন আমল থেকে। বস্তা বস্তা রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হলেও অদ্যাবধি মামলা হয়নি।

প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিঃ নামক আরেকটি বীমা প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয় মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহর কমিশন। তৎকালীন পরিচালক (দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল) উত্তম কুমার ম-লের স্বাক্ষরে অভিযোগটি ‘ব্যবস্থা নেয়া’র কথা বলে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয় (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.১৯৭.২২-২০৯৬০) আইনগত এখতিয়ারবিহীন ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ-আইডিআরএ’র কাছে।
 

একইভাবে গতবছর ২১ জানুয়ারি অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ ‘ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে’ উত্তম ম-ল পাঠিয়ে দেন (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.৫৬৮.২০২৩-২৫১১) পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি)’র। বিশাল অঙ্কের অবৈধ সম্পদ এবং অর্থ পাচারের সঙ্গে ব্যাংক এবং কাস্টমসসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ হিসেবে অভিযোগটি শতভাগ দুদকের তফসিলভুক্ত। কিন্তু উত্তম কুমার ম-ল এটি সিআইডিতে পাঠিয়ে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দেন। অভিযোগ রয়েছে, এই দায়মুক্তির বিপরীতে উত্তম ম-ল গং অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে নিয়েছেন মোটা অংকের নজরানা। উত্তমচক্রের অন্যতম সদস্য ইমরুল কায়েসের পকেট থেকে একবার ৫ লাখ টাকার প্যাকেটও উদ্ধার হয়। কিন্তু মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর কমিশন ‘শাস্তিস্বরূপ’ প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তাকে নির্বিঘেœ জনপ্রশাসনে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।

পক্ষান্তরে, বিপরীত ঘটনা ঘটান এই বিতর্কিত কর্মকর্তা। এটি ২০২২ সালের ২১ জুনের ঘটনা। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেশবরেণ্য ১১৬ আলেম, জনপ্রিয় বক্তা এবং ইসলামী চিন্তাবিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২২১৫ পাতার কথিত ‘শ্বেতপত্র’ আমলে নিয়ে ত্বরিৎ অনুসন্ধানের সুপারিশ (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০৩.৩১.০১৯.২২.৫১)।

দিয়ে দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল’ সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক (পরিচালক) উত্তম কুমার ম-ল এ টিম গঠন করে ফেলেন। পরে অবশ্য আলেম-ওলামাদের প্রতিবাদের মুখে অনুসন্ধান থেকে সরে আসে মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর কমিশন। এমন দৃষ্টান্ত অনেক দেয়া সম্ভব।

যাদের হাতে দুর্নীতির ‘যাচাই-বাছাই’ : দুর্নীতির অভিযোগ প্রাথমিকভাবে বাছাইয়ে একাধিক কমিটি প্রতিষ্ঠানটিতে সব সময়ই ছিলো। কমিশন সাধারণত দুদক আইনে অভিজ্ঞ, দক্ষ এবং সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাছাই কমিটিতে রাখা হতো। একেকটি বাছাই কমিটিতে ৩ জন কর্মকর্তা থাকতেন। কিন্তু বিগত কমিশন ৩টি বাছাই কমিটি ভেঙ্গে একটি কমিটি করে। বাড়ায় কমিটির সদস্য সংখ্যাও। ব্যাপক এখতিয়ার প্রদানের পাশাপাশি বাছাই কমিটির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রশাসন ক্যাডারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। অভিযোগ যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত বিধিতে ‘যাবাক’র দায়িত্বে থাকার কথা মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত)। কিন্তু তাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। প্রতিটি কমিশন এই অনুবিভাগকে সব সময় প্রেষণে আসা প্রশাসন ক্যাডারের হাতেই রাখে। এ ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে বর্তমান কমিশনও। মহাপরিচালক (প্রশাসন) আবু হেনা মোস্তফা জামানসহ অনুবিভাগটিতে রয়েছেন ৮ কর্মকর্তা। কমিটির সদস্য সচিব পরিচালক (প্রেষণে আসা প্রশাসন ক্যাডার) ঈশিতা রনি। সদস্য হিসেবে রয়েছেন উপ-পরিচালক (প্রশাসন ক্যাডার) হাবিবুর রহমান, দুদকের নিজস্ব উপ-পরিচালক নূর জাহান, সাইফুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মাহমুদুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন। এছাড়া যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক, সাবিকুন নাহার ও রুবেল হোসেন। জানা গেছে, প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে যেসব সদস্য রয়েছেন তাদের এখতিয়ার ক্লারিক্যাল কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

অর্থাৎ অভিযোগ অনুসন্ধানযোগ্য কি নাÑ এই সিদ্ধান্তটি নিচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারাই। দুর্নীতি অনুসন্ধান-তদন্ত এবং দুর্নীতি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে মহাপরিচালকসহ কারোরই কোনো অভিজ্ঞতা নেই। একই কারণে দুদকের তফসিল সম্পর্কেও তারা অনভিজ্ঞ। যে কাজটি তারা দক্ষতার সঙ্গে করেন সেটি হচ্ছে, প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলো কিনা সেটি লক্ষ্য রাখা। যা কি না সংস্থাটির আইনে উল্লেখিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তফসিল (ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, আত্মসাৎ, জাল-জালিয়াতি ও মানিলন্ডারিং)।

অভিযোগ রয়েছে, যাবাক সচারাচার প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সুপারিশ করে না। ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী এবং লুটপাটের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কিছু আমলাকে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। বিগত রেজিমের দুর্নীতিবাজ বিশাল আমলাচক্রের শরীরে এখনো মেসিভ কোনো আঁচড় পড়েনি।

সংস্থাটির সিনিয়র কর্মকর্তারা জানান, যা.বা.ক. সদস্যদের অনভিজ্ঞতা, অদক্ষতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা। যে কারণে দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে দুদক তার ‘হয়রানিমূলক’ ও ‘উন্নয়ন-প্রতিবন্ধক’ প্রতিষ্ঠানের তকমা এখনো ঘুচাতে পারেনি।
এদিকে বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে গতকাল (শনিবার) যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় সংস্থার মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) ও মুখপাত্র মো: আকতার হোসেনের সঙ্গে। একাধিকবার কল করা হলেও সাড়া মেলেনি।