
এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ফাইয়াজ, আহনাফ, সাদ, মারুফ, জাহিদ ও সৈকতের। বৃহস্পতিবার প্রথম পরীক্ষার দিন তাদের স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সহপাঠীরা। পরীক্ষার প্রথম দিন গতকাল ছয় পরিবারে কান্নার রোল উঠে। পরিবারের সদস্যরা ছাত্রদের বই-খাতা বুকে নিয়ে বিলাপ করে কান্না করেন। নিজ নিজ কলেজের শিক্ষকদের অনেকের চোখের কোণে পানি জমতে দেখা গেছে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে কেউ শহীদ হয়েছেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি, কেউ আগস্টের শুরুতে। তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর কিছুদিন আগে ফেসবুকে লিখে গেছেন বর্ণময় বিদায়বার্তা। তাদের গল্প-স্মৃতি স্মরণ করে বৃহস্পতিবার সহপাঠীদের অনেককেই পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে। ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া। তার ডাকনাম ফারহান ফাইয়াজ। ১৮ জুলাই আন্দোলনের সময় তার বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মারা যান ঘটনাস্থলেই। তার এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। বাবা শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, ‘আমার ছেলেটা পড়াশোনা শেষ করে গবেষক হতে চেয়েছিল। বিদেশে পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরে গবেষণা করার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। পরীক্ষার আগের দিন রাতে তার বন্ধুরা ফোন করে আমার কাছে দোয়া নিয়েছে। আবদুল্লাহ বিন জাহিদ শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ৫ আগস্ট রাতে উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। জাহিদকে ছাড়াই বৃহস্পতিবার পরীক্ষায় বসেছেন তারা ঘনিষ্ঠ পাঁচ বন্ধু লামিম, হাসান, সালেহীন, রাকিব ও মেহেদি। জাহিদের মা ফাতেমা-তুজ-জোহরা এখনো ছেলের শোকে পাথর।
তিনি বলেন, ‘ওর কলেজ থেকে পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে আমাকে ডেকেছিল। আমি যাইনি। মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে ৪ আগস্ট শহীদ হন শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ। তিনি ছিলেন বিএএফ শাহীন কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী। গানপ্রিয় ও স্কাউট সদস্য আহনাফকে মঙ্গলবার বাংলাদেশ স্কাউটস ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করে। প্রধান উপদেষ্টা নিজ কার্যালয়ে আহনাফের মায়ের হাতে পুরস্কারটি তুলে দেন। পুরস্কার হাতে নিয়েই স্মৃতিফলকে গিয়ে ছেলের সোনালি প্রতিকৃতি ছুঁয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আজ ও বেঁচে থাকলে পরীক্ষার হলে যেত। আহনাফের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, ‘পরীক্ষার সময় এসেছে, বুকটা আরও বেশি খালি লাগছে। ছেলের রেজিস্ট্রেশন কার্ডটা এখন শুধু যন্ত্রণার স্মৃতি।’ মারুফ হোসেন, যার বয়স ছিল ১৯ বছর।
২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার করেছিল ডিবি। সেই থেকেই তাকে নিয়ে পরিবার ছিল শঙ্কিত। এরপর তাকে বরিশালে নানা বাড়িতে রাখা হয়। কাজীরহাট একতা ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবার তার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা ছিল। ১৯ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি। তার লাশ পাওয়া যায় ৩ দিন পর অর্ধগলিত অবস্থায়। বাবা মো. ইদ্রিস বলেন, ‘ও ছিল আমার বন্ধুর মতো। কবরস্থান থেকে বলা হয়েছে ১০ লাখ টাকা না দিলে কবরটা রাখবে না। আর ওর মা ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
ঢাকা কমার্স কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন আব্দুল আহাদ সৈকত। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সৈকত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নেন বাবার সঙ্গে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজের সামনে মাথায় গুলি লেগে শহীদ হন তিনি। বেঁচে থাকলে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতেন। তার বাবা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এক ঘণ্টা বেঁচেছিল। আমি ছিলাম পাশে। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমার ছেলে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, আজ তাকে শুধু কবরে দেখতে পারি।’ সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন সাদ। ৫ আগস্ট ধামরাইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ৮ আগস্ট মৃত্যু হয় তার। ফ্রিল্যান্সিং করে পরিবারের জন্য কিছু করতে চাওয়া সাদ ছিলেন গ্রাফিক ডিজাইনে পারদর্শী। তারও এবার এইচএসসি পরীক্ষায় বসা হলো না। মৃত্যুর আগের দিন ৪ আগস্ট তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘যে দেশের ইতিহাস রক্ত দিয়ে শুরু হয়েছে, ওই ইতিহাস আবার লিখতে রক্তই লাগবে।’ সাদকেও আহনাফের মতো মঙ্গলবার ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করা হয়েছে। তার বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলেটা এখনো চোখের সামনে ভাসে। নিজের নকশায় আন্দোলনের পোস্ট বানিয়ে ফেসবুকে দিত। আরও কত কত স্মৃতি যে ছিল তার।’