Image description
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২২ জুন যখন ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার যুদ্ধে সরাসরি যোগ দিলেন, তখন মনে হচ্ছিল পরিস্থিতি আরও ভয়ানক রূপ নেবে। এ সংঘাতের সূত্রপাত গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে শুরু হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের নাতাঞ্জ, ফর্দো ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ১৭টি বাঙ্কার-বিধ্বংসী বোমা ও দুই ডজন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। মূলত ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েলকে সহায়তা করার জন্যই এ হামলা চালানো হয়। এতে ভয়ানক প্রতিশোধের চক্র তৈরির শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও। এরপর সোমবার কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি আল-উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে জবাব দেয় তেহরান। এর ফলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হয়েছিল। তবে তেমন কিছু ঘটেনি।

উল্টো হামলার কয়েক ঘণ্টা পরই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। মূলত এ যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছিল কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আলজাজিরার এক এক্সপ্লেইনারে বলা হয়েছে, প্রতিশোধমূলক হামলা পরে হলেও ‘পর্দার আড়ালের যোগাযোগ’ সম্ভবত আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।

ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পর মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা ছিল একেবারেই প্রত্যাশিত। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটিগুলোর কয়েকটি ইরানের আশপাশেই অবস্থিত। আল-উদেইদ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর বাহরাইনে অবস্থিত। এ দুটির অবস্থান ইরান থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি দূরত্বে। এ ছাড়া সৌদি আরবে যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি, ইরাকে তিনটি এবং কুয়েত ও জর্ডানে একটি করে মার্কিন বিমান ঘাঁটি আছে। ওমানে চারটি লজিস্টিকস-সংক্রান্ত মার্কিন বিমান ঘাঁটি আছে। আলজাজিরার সাংবাদিক দোরসা জাব্বারি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯টি ঘাঁটিতে ৪০ হাজার সেনা রয়েছেন। ঘাঁটিগুলোর আটটি স্থায়ী। ইরান আগে থেকেই বলে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে হামলা চালায়, তবে এসব ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করা হবে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) এক বিশ্লেষণে বলেছে, আগে যখন কেউ ইরানকে আঘাত করেছে, তখন তেহরান নিজেদের সেনা না পাঠিয়ে সমর্থক মিলিশিয়া গোষ্ঠী দিয়ে (যেমন ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ) প্রতিশোধ নিয়েছে। এটাই ছিল তাদের প্রধান কৌশল। সেই হিসেবে হুতি মিলিশিয়ারা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা চালাতে পারত কিংবা ইরান নিজেই হরমুজ প্রণালিতে জাহাজে হামলা করতে পারত। আর এমনটি ঘটলে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাণিজ্যিক নৌপথ হুমকির মুখে পড়ত। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনো হামলা হয়নি।

তবু পুরো বিশ্ব যখন ইরানের পক্ষ থেকে বড় প্রতিশোধের অপেক্ষায় ছিল, তখন সোমবার ব্রিটেনের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আনসারি আলজাজিরাকে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর একটা পথ খোলা থাকতে পারে। ‘বাহ্যিকভাবে অনেক হুমকি আসবে। কিন্তু পর্দার আড়ালে আলোচনা চলবে।’ এ কথা বলার কয়েক ঘণ্টা পরই ইরান মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়।

স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় ইরান কাতারের দিকে হামলা চালায়। কাতার এ হামলাকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক ও কাতারের সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানায় এবং দোহায় ইরানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। তবে বিশেষজ্ঞ আনসারির বলা ‘পর্দার আড়ালের যোগাযোগ’ সম্ভবত আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।

ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘আমাদের আগেভাগে জানানোয় ইরানকে ধন্যবাদ। এতে কোনো প্রাণহানি হয়নি, কেউ আহতও হননি।’ এই সতর্কতার ফলে কাতারও প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। তারা ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৩টি ভূপাতিত করে এবং একটি ক্ষেপণাস্ত্র ‘নিরাপদ’ পথে যেতে দেয়।

কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র আগেই আল-উদেইদ ঘাঁটি থেকে বিমান ও কর্মীদের সরিয়ে নেয়। তাই হামলাটি প্রাণহানির দিক থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি বা কাতার বিমানবাহিনীর উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। হামলার তিন ঘণ্টা পর ট্রাম্প লেখেন, ‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, কোনো মার্কিন নাগরিক আহত হননি। তেমন কোনো ক্ষতিও হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, তারা (ইরান) তাদের ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেছে।’

এর মাত্র দুই ঘণ্টা পরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। তিনি লেখেন, ‘সবাইকে অভিনন্দন! ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি কাতারে। দেশটি ওয়াশিংটনের সঙ্গে আফগানিস্তানের তালেবান ও গাজার ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস নিয়ে অনেক কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা করেছে। অন্যদিকে, ইরানের সঙ্গেও উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে কাতার। যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ট্রাম্প কাতারের আমিরকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আমি কাতারের অত্যন্ত সম্মানিত আমিরকে ধন্যবাদ জানাই, যিনি এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক সাহায্য করেছেন।’ এদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান গত মঙ্গলবার কাতারের আমিরকে ফোন করে আগের দিনের হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।

এরই মধ্যে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানি বুধবার বলেন, ‘কাতার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় করে উত্তেজনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে।’

যুদ্ধবিরতিতে সংঘাত থামলেও কথার লড়াই থামছে না। গতকাল ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মুখে জোরালো চড় মেরেছি। ইরানের প্রতি ‘আত্মসমর্পণের’ দাবি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো ব্যক্তির মুখে শোভা পায় না।’ ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের দুদিন পর এক ভিডিও বার্তায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ কথাগুলো বলেন। ভিডিও বার্তায় তিনি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘জয়’ লাভ করায় ইরানি জনগণকে অভিনন্দন জানান।

এদিকে, মার্কিন হামলায় ইরানের পরমাণু স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও বিভিন্ন বক্তব্য আসছে। বোমাবর্ষণের পর ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ফাঁস হওয়া দেশটির গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থাপনার উপরিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অভ্যন্তরে তেমন ক্ষতি হয়নি। শুধু তাদের কার্যক্রম কয়েক মাসের জন্য পিছিয়েছে। এরপর ট্রাম্প সেই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করলেও বুধবার পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়ে সংশয়ের কথা স্বীকার করেছেন ট্রাম্প ও তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক জন র্যাটক্লিফ ট্রাম্পের পূর্বের মতামত সমর্থন করে বলেন, মার্কিন হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে। যদিও ঘটনাস্থলে ইরান এখনো কোনো তদন্ত দলকে যেতে না দেওয়ায় পরিস্থিতির বাস্তব মূল্যায়ন জানা যায়নি।