Image description
প্রসিকিউশনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল । ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’: হত্যার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা । প্রথম শহীদ আবু সাঈদ ছিল জুলাই অভ্যুত্থানে সাহসের বাতিঘর । পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয় সাঈদ ।

জুলাই অভ্যুত্থানে প্রথম শহীদ রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ১৬ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন। পুলিশ খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন। তার বুক পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির আঘাত। জুলাই আন্দোলনের প্রথম শহীদ তিনি। পুলিশের সামনে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ ছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানের সাহসের বাতিঘর। তার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট চাপ দিয়ে ছয়বার পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয় সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের নিপীড়নকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিবেচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার পর চতুর্থ কোনো মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। গত ২৪ জুন একটি অভিযোগে এই প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। এতে ৩০ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ৩০ জনের মধ্যে ৮ জন পুলিশ, অন্য ২২ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তা। এর মধ্যে চারজন গ্রেফতার আছেন। গোপনীয়তার স্বার্থে এদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আবু সাঈদ ১৬ জুলাই হাতে একটি মাত্র লাঠি নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। সেদিন সাঈদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে গুলি করার ভিডিও সংবাদমাধ্যমে প্রচার হলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন থেকেই সারা দেশে তীব্র গতিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন থেকে সারা দেশে ডাকা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হয়। এর ধারাবাহিকতার পরিণতিতে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাদ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তদন্ত সংস্থার জমা দেওয়া সব তথ্য-প্রমাণ ও আলামত চিফ প্রসিকিউটর আইন অনুযায়ী বিশ্লেষণ করবেন। তিনি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করবেন। তারপর বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, তারা তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে আগামী রোববার ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করবেন।

প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে সূত্র জানায়, গুলির কারণে আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মারা যান। এই হত্যার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বারবার পরিবর্তন করা হয়। চাপ দিয়ে ছয়বার প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয় সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে। যারা চাপ দিয়েছিলেন তারা সবাই ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ। এদের মধ্যে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দুজন প্রাক্তন উপকমিশনার, রংপুর মেডিকেল কলেজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগপন্থি ডাক্তারদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) একজন নেতা রয়েছেন।

প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, আবু সাঈদ হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের কাছে জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত প্রতিবেদনে ৩০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন, অন্যান্য নথিপত্র এবং জুলাই আন্দোলনের তথ্য-উপাত্ত ও পটভূমি পর্যালোচনা করে আগামী রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হবে বলে আশা করছেন তিনি। মিজানুল ইসলাম বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই বেলা ২টা ১৭ মিনিটে আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কাউকে আক্রমণ করেননি। দুজন তাকে গুলি করেছেন। তিনি বলেন, আপনারা ভিডিওতে দেখেছেন কীভাবে আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কারা গুলি করেছিল।

এর আগে গত ১৫ জুন এ মামলার চার আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী (আকাশ)। চার আসামির মধ্যে আমির হোসেন ও সুজন চন্দ্র রায়কে ১৮ জুন এবং শরিফুল ইসলাম ও ইমরান চৌধুরীকে ১৯ জুন জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রতিবেদনে জানা যায়, ট্রাইব্যুনালের দুই প্রসিকিউটরের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের তদন্ত দল ময়নাতদন্তকারী রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. রাজিবুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। যিনি এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশ করেছিলেন। যে অফিসে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পরিবর্তন করা হয়েছিল সেখানে প্রবেশকারীদের গতিবিধি এবং ডিজিটাল প্রমাণও সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা।

২০০১ সালে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করা আবু সাঈদ ছিলেন ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, ছিলেন সবার আদরের। পিতা মকবুল হোসেন পেশায় একজন দিনমজুর। রংপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। গত ১৩ জানুয়ারি আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসে ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। ওইদিন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, অভিযোগ দিতে আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান ও তার সঙ্গে ঘটনার সময় যেসব সহযোদ্ধা ছিলেন তারা এসেছেন। পরিবারের সদস্যরা সেই ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়ে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।