
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর যে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল , তা বাস্তবায়নের পথে শুরু থেকে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবহন খাতের প্রভাবশালী মালিক - শ্রমিক সংগঠনগুলো । এখন পরিবহননেতারা আইন সংশোধনের সুপারিশ করে শাস্তি ও জরিমানার হার কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন । তাঁরা আইনের সব ধারা জামিনযোগ্য করার , কারাদণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো এবং জরিমানা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর প্রস্তাব করেছেন । সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ও প্রস্তাবগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে এবং আইন সংশোধনের ব্যাপারে তারা ইতিবাচক বলে জানা গেছে । পরিবহন খাতের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ২২ জুন বিদ্যুৎ ভবনে এক সভা হয় ।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সড়ক পরিবহন আইন , ২০১৮ সংশোধন নিয়ে পরিবহনমালিকদের দাবিগুলোর বিষয়ে আলোচনা হয় । সভা সূত্রে এমনটি জানা গেছে ।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত রোববার আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারার বিষয়ে পরিবহনমালিকেরা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন ; বিশেষ করে আইনের যে ধারায় পেনাল্টি আছে , সেগুলো শ্রমিকদের জন্য অনেক কঠিন বলে মালিকেরা দাবি করেছেন । ফলে পরিবহনমালিকেরা কিছু ধারার বিষয়ে সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন । আইন পরিবর্তন করতে হলে আন্তমন্ত্রণালয় মিটিং লাগবে , আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং লাগবে । কিন্তু বিষয়টি এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি । আমরা এগুলো একটা প্যাকেজ হিসেবে কনসিডার করব , সড়কে শৃঙ্খলা আনাটাই আমাদের মূল লক্ষ্য । সে ক্ষেত্রে মালিক - শ্রমিকদের সহযোগিতাও লাগবে । সড়কের শৃঙ্খলাভঙ্গ না করে তাদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায় , সে বিষয়টা আমরা বিবেচনা করছি । ' বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলার অভাব বহুদিনের ।
এ ছাড়া সড়ক পরিবহন আইন , ২০১৮ - এর ধারা -৯৮ এ ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মোটরযান চালনার ফলে দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের দণ্ড অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা ৩ বছরের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং আদালত জরিমানা সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন । এখানে জরিমানা বা অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং আদালত জরিমানা জরিমানা সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন বলে প্রস্তাব করা হয় । এই আইনের অপব্যবহার বন্ধ করা এবং কন্ডাক্টর , সুপারভাইজার ও সহকারীকে এই মামলায় আসামি করা যাবে না এবং ধারাটি জামিনযোগ্য করতে হবে বলেও প্রস্তাব করা হয় ।
সড়ক পরিবহন আইন , ২০১৮ - এর ধারা -১০৫ এ দুর্ঘটনাসংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছে । এই আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন , মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত হলে বা তার প্রাণহানি ঘটলে তৎসংক্রান্ত অপরাধসমূহ ( Penal Code , 1860 Act No XLV of 1860 ) এর এতৎসংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে । এ জন্য অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হবে । এখানে জরিমানা ৯০ শতাংশ ও কারাদণ্ড ৪০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে । এ ক্ষেত্রে অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা ৩ বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং ধারাটি জামিনযোগ্য করতে হবে বলে প্রস্তাব করা হয় । এ ছাড়া সভায় এই আইনে যাত্রী ও মোটরযানের বিমার বিষয়ে এবং সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ায় প্রক্রিয়া সংশোধন বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে । বিদ্যমান আইনে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয় ক্ষতিপূরণ পাওয়ায় জন্য । এই আবেদনের মেয়াদ ৯০ দিন করার দাবি জানানো হয়েছে । একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ায় প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং দ্রুত করার দাবি করেছেন মালিকেরা ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব মো . সাইফুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ সড়ক পরিবহন আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধনের বিষয়ে আমরা প্রস্তাব করেছি । যথাযথ বিবেচনার জন্য সরকার একটি সাবকমিটি করে দিয়েছে । সেই কমিটির মাধ্যমে বিষয়গুলো আলোচনা করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে । দুর্ঘটনা হলেই চালকেরা জামিন পাচ্ছেন না । এর ফলে চালকের পেশায় আর কেউ আসতে চান না । এতে চালকের সংকট তৈরি হচ্ছে । এই অজামিনযোগ্য ধারাগুলো জামিনযোগ্য করার বিষয় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ।’
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড . শামসুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ অনেক স্টেকহোল্ডারের মতামত নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা আইন প্রণয়ন করা হয় । ২০১০ সালের যে আইনটা তৈরি হয়েছিল , সেটার ধারেকাছে নেই ২০১৮ সালের আইন । কাটছাঁট করে একটা তৈরি করা হয়েছিল । এখন যদি কোনো সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় , সেটা একপক্ষীয় হয়ে গেলে আইনের সর্বজনীনতা হারিয়ে ফেলবে । যদি আইন পরিবর্তন করতেই হয় , তাহলে সব স্টেকহোল্ডারের মতামত নিয়ে করাটাই ভালো হবে । '