Image description

জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় সারা দেশে এ পর্যন্ত ৭৬১ টি মামলা হয়েছে । এসব মামলায় আসামির তালিকায় পুলিশের ১ হাজার ১৬৮ সদস্যও রয়েছেন । তাঁদের মধ্যে পুলিশের কয়েকজন সাবেক মহাপরিদর্শক ( আইজিপি ) থেকে শুরু করে কনস্টেবল পদের সদস্যরা রয়েছেন । মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর কিংবা গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে । দেড় হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৪২ জন । ঘটনার প্রায় ১১ মাস পরও কোনো মামলার তদন্ত শেষ হয়নি । ফলে তদন্ত নিয়ে ধীরে চলার অভিযোগ করছেন কেউ কেউ । তবে তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন , এসব স্পর্শকাতর মামলা । পুলিশ সদস্যরা আসামি থাকায় তদন্ত করতে হবে নির্ভুল ।

কারণ , তাঁদের বেশির ভাগ বাহিনীতে কর্মরত থাকায় তাড়াহুড়োর তদন্তে ভুল হলে বাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে । তাই প্রশ্ন ও বিতর্কমুক্ত রাখতে মামলাগুলোর তদন্ত ধীরেসুস্থে করতে চান তাঁরা । একই কারণে কর্মরত সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ না পেলে গ্রেপ্তারও করা হবে না ।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক ( আইজিপি ) বাহারুল আলম এ বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আটটি রেঞ্জেই অতিরিক্ত ডিআইজি ( অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ) পর্যায়ের কর্মকর্তা দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে । তাঁরা কাজ করছেন । জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে ।

একটি মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের ( ডিএমপি ) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পুলিশের আট সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ইতিমধ্যে দাখিল করা হয়েছে । পুলিশের সূত্র বলছে , গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র- জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সারা দেশে হত্যা , হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় ৭৬১ টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে । এসব মামলায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী সংগঠনের নেতা- কর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও আসামি করা হয় । এসব মামলা করেন জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজন এবং আহত ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা । এসব মামলায় আসামি হিসেবে আছেন পুলিশের ১ হাজার ১৬৮ পুলিশ সদস্য । তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৭ জন সাবেক আইজিপি , ৪১ অতিরিক্ত আইজিপি , ১২ সাবেক ডিআইজি ও ১১ জন বর্তমান ডিআইজি , জন অতিরিক্ত ডিআইজি , ৬৬ পুলিশ সুপার ( এসপি ) ৬৫ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার , ৩৫ সহকারী পুলিশ সুপার , ১৮৭ পরিদর্শক , ৩৪০ উপপরিদর্শক ( এসআই ) , ১১৭ এএসআই , ২২৪ জন কনস্টেবল । বাকিরা টিএসআই , এটিএসআই , নায়েক ও পদ উল্লেখ না থাকা পুলিশ সদস্য । তাঁদের মধ্যে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪২ জন ।

পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী , বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের ৪৬ সদস্য নিহত হন । বেশি মামলা ‘ ডিবি ’ হারুনের বিরুদ্ধে , দ্বিতীয় সাবেক আইজিপি মামুন মামলা হওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল - মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, ডিএমপির সাবেক কমিশনার মো . আছাদুজ্জামান মিয়া, যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমান , ডিআইজি মোল্লা নজরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ( সিএমপি ) সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম ।

সর্বশেষ গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয় সিএমপির সাবেক কমিশনার অতিরিক্ত আইজিপি ইকবাল বাহারকে । মামলার আসামি হলেও গ্রেপ্তার করা যায়নি বিতর্কিত সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো . মনিরুল ইসলাম , ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান , ডিএমপির ডিবির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ , যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার , মেহেদী হাসান , অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তারসহ অনেককে । তাঁদের অনেকে দেশত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র ।

মামলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , সবচেয়ে বেশি ১৭৫ টি মামলা হয়েছে ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে । এরপর রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল - মামুন ( ১৫৯ টি ) ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ( ১১৮ টি ) , যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ( ১২৯ টি ) , সাবেক আইজিপি শহীদুল হক ( ২৪ টি ) , বেনজীর আহমেদ ( ১৩ টি ) ও জাবেদ পাটোয়ারী ( ২ টি ) । ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপকমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৭ টি । আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায় , তিনি গুলি চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করার কৌশল নিয়ে আলোচনা করছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে ।

৬৮ মামলার তদন্ত করছে পিবিআই পুলিশ সদস্যরা আসামি থাকা মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ( পিবিআই ) ৬৮ টি মামলার তদন্ত করছে । এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে পুলিশের ৯৯ কর্মকর্তাকে । সিআইডি ও অন্য ইউনিটগুলোও বিভিন্ন মামলার তদন্ত করছে । তবে কোনোটির তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন , পরিদর্শক থেকে কনস্টেবল — কেউ নিজের সিদ্ধান্তে গুলি চালান না । মাঠে দায়িত্ব পালন করা সবাই আদেশ পালন করেছেন । এখন কাকে ‘ হত্যাকারী ' বলা হবে ? মাঠপর্যায়ের একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন , মাঠে দায়িত্ব পালন করায় তাঁরা পরিস্থিতি বোঝেন । তদন্ত শেষে অভিযোগপত্রে সহকর্মীর নাম দিতে হলে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে । না হলে তিনি বাহিনীর অন্যদের রোষানলে পড়বেন । তাঁরা বলছেন , আসামি করা বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে । গুলি চালানোর স্পষ্ট প্রমাণ না থাকলে বা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত না হলে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া কঠিন । তাই চাকরিতে থাকা পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারও করা যাচ্ছে না ৷

পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন , সরাসরি প্রমাণ ছাড়া শুধু মামলার আসামি হওয়ার কারণে সবাইকে গ্রেপ্তার করলে বাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে , যা তদন্ত ও বিচারকে ব্যাহত করবে । জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা আজকের পত্রিকাকে বলেন , শুধু পুলিশের বিরুদ্ধে মামলাগুলো নয় , অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক হত্যা - হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন অভিযোগে যত মামলা হয়েছে , সব কটির তদন্ত দ্রুত শেষে করা দরকার ।

যাঁরা নির্দোষ , তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া এবং যাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাবে , তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা উচিত । এই মামলাগুলো নিয়ে ধীরগতির সুযোগ নেই । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও পুলিশের বিচার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও শুরু হয়েছে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলার বিচারপ্রক্রিয়া । ট্রাইব্যুনালে ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎকালীন ১৮ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ।

এর মধ্যে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার মো . জসীম উদ্দীন মোল্লা , পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন , মহিউদ্দিন ফারুকী , এস এম তানভীর আরাফাত , আসাদুজ্জামান , আবদুল্লাহিল কাফী , জুয়েল রানা প্রমুখ । ইতিমধ্যে চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা । ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে , হাবিবুর রহমানের মৌখিক নির্দেশেই মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান । জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন , আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের প্রক্রিয়া চলছে । যাঁরা পলাতক , তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে । প্রয়োজনে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই বিচার চলবে এবং রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তাঁদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন ।