Image description

শাওন। সবেমাত্র বিয়ে করেছেন। ভালোই চলছিল তাদের জীবন-সংসার। মাস ছয়েক যেতে না যেতেই তাদের সুখের জীবনে নেমে আসে ঘোর অমাবস্যা। একদিন নিজের বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করছিলেন। হঠাৎ সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কথা আছে বলে তাকে নিয়ে যায়। থানায় বহু খোঁজাখুঁজির পরেও দুইদিনেও হদিস মিলেনি তার। পরে জানতে পারেন হেরোইনের একটি মামলায় শাওনকে আটক করেছে র‌্যাব। শাওনের মায়ের দাবি ২০২১ সালে নিজের বাসা বাড়ি থেকে র‌্যাব নিয়ে যায় ছেলেকে। সেই থেকে মিথ্যা মামলায় গত চার বছর ধরে শাওনের দিন কাটছে কারাগারে। গতকাল আদালতে এসেছিলেন ছেলের জামিনের খবর নিতে। সঙ্গে এসেছেন শাওনের স্ত্রী, একমাত্র সন্তান। কবে নাগাদ জামিন হতে পারে শাওনের- মায়ের এমন প্রশ্নের জবাবে আইনজীবী জানান, আগামী মাসে চান্স আছে। আইনজীবীর এ কথা শুনে শাওনের মা ও স্ত্রীর চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরতে থাকে চোখের পানি। যাওয়ার সময় শাওনের ছেলে আইনজীবীকে বলে, উকিল আঙ্কেল আমার বাবাকে আর আটকিয়ে রেখো না। বাবারে একটু ছেড়ে দাও। আদালত পাড়ায় এমন খবর অহরহ। মামলায় ঝরিয়ে জীবন সংসার ছিন্ন ভিন্ন। নিঃস্ব হয়ে যায় পরিবার।

শাওনের মা জানায়, অল্প বয়সে বোনঝির সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। ভালোই চলছিল তাদের সংসার। একদিন সিভিল ড্রেসে কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাড়ি থেকে তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। থানায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও সন্ধান পাননি। দু’দিন পরে জানতে পারেন ছেলে শাওনকে হেরোইনের মামালায় আটক করা হয়েছে। অথচ আমার ছেলে কখনো নেশা পানিও করতো না। অথচ সেই ছেলেকেই র‌্যাব বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে দু’টি মিথ্যা মামলা দিছে। একটা হেরোইনের মামলা, আরেকটা অস্ত্র মামলা। চলতি বছরের শুরুতে হেরোইনের মামলায় শাওনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। শাওনের মা জানান, ছেলে কারাগারে যাওয়ার পর থেকে ঘুম নেই। না ঘুমাতে ঘুমাতে শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে। ছেলের বউ আর নাতির চেহারার দিকে তাকানো যায় না। নাতিটা আমার এখন পর্যন্ত বাবার কোলেও উঠতে পারেনি। বাবা থেকেও নাতি এখন আমার এতিমের মতো। বউ স্বামী থাকতেও বিধবার মতো জীবন পার করছে। কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। শাওনের মা বলেন, এই সরকার আসার পর কত বড় বড় মামলার আসামি জামিন পেলো অথচ আমার ছেলের জামিন হচ্ছে না। টিভিতে দেখি বড় বড় হত্যা মামলার আসামিও জামিন পাচ্ছেন। অথচ আমার ছেলের জামিন হচ্ছে না। শাওনের স্ত্রী বলেন, মিথ্যা মামলায় স্বামীর যাবজ্জীবন হয়েছে। এখন আছেন কাশিমপুর কারাগারে। এক মাস পর পর ঢাকা থেকে বহু কষ্টে কাশিমপুর কারাগারে দেখতে যাই। আগামী মাসেই জামিন হবে- এসব কথা বলে আসি। কিন্তু জামিন হয় না। জামিন না হওয়ায় শাওন কারাগারে আত্মহত্যারও চেষ্টা করে ছিল।  শাওনের আইনজীবী জানান, উচ্চ আদালতে শাওন বেকসুর খালাস পাবেন। তিনি যে এই মামলার সঙ্গে জড়িত নন তা প্রমাণিত হবে।

আদালতে খোঁজ নিলে এমন অনেক হৃদয় বিদারক ঘটনার খবর শোনা যায়। গতকাল সিএমএম আদালতের সামনে দেখা যায় আরেক হৃদায় বিদারক ঘটনা। রহিমা নামে এক নারী সকালে ছোট্ট শিশুকে নিয়ে এসেছেন। স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দীর্ঘক্ষণ সিএমএম আদালতের গারদ খানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গারদ খানা থেকে কখন যেন স্বামীকে এজলাসে তুলছেন টেরই পায়নি। তপ্ত দুপুর। হঠাৎ প্রিজন ভ্যান  থেকে স্বামীর কণ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে প্রিজন ভ্যানের পিছনে ছুটতে থাকে। একপর্যায়ে স্বামীকে দেখতে ছেলেকে নিয়ে সিএমএম আদালতে প্রবেশ পথের গেটে উঠে। প্রিজনভ্যানের সঙ্গে একটু ধাক্কা লাগলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেত। কিন্তু এত কিছুর পরেও একনজর দেখতে পারেনি স্বামীকে। কথা হয় ওই নারীর সঙ্গে। তিনি জানান,  স্বামী, সন্তানকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার ছিল। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। ভালো ভাবে চলার জন্য আসেন শহরে। ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। হঠাৎ এক মামলায় তাদের সংসার এখন ছিন্ন ভিন্ন। ছোট্ট শিশুকে বাসায় রেখে অন্যের বাসায় কাজ করে জীবন সংসার চলে।

বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাস। মাদক মামলায় ছয় বছর ধরে খুলনা জেলা কারাগারের কনডেম সেলে আছেন। স্বামী কারাগারে থাকায় তাদের জীবন এখন ছিন্ন ভিন্ন। সন্তান নিয়ে কষ্টে কাটছে তার দিন। গতকাল তার স্ত্রী রিমা বিশ্বাস আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে সরাসরি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, তার স্বামী গত ছয় বছর ধরে মিথ্যা মামলায় সাজা খাটছেন। আমার স্বামী নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে মামলাটা ঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি। তার কোনো ভালো আইনজীবী ছিল না, আমরা খুব গরিব মানুষ। তিনদিনের সুযোগ দিন, আমার স্বামী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে। জেল থেকে নিজের হাতে লেখা ছয় পাতার চিঠিতে প্রধান বিচারপতিকে বলেন, তিনদিন সময় দিন, যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারি, তাহলে ফাঁসি দিন। আমি কোনোভাবে এ মামলায় জড়িত না। একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া মানে শুধু ওই ব্যক্তি নয়, তার পুরো পরিবারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া। আমি যদি আমার মামলা নিজেই শুনানি করে নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে উচ্চ আদালত যেন আমাকে দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেন।

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, একটি মামলার প্রভাব পুরো পরিবারের উপরে পড়ে। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি মামলায় জড়িয়ে পড়ার কারণে সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যায়। মামলায় জড়িত হওয়ার মতো কোনো কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান সমাজ বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ড. শাহজাহান সাজু আমলযোগ্য হলেও অভিযোগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মামলার এফআইআর গ্রহণ না করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। অভিযোগ পাওয়ার পর প্রাথমিক তদন্ত ও তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলেন। তিনি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে মামলা গ্রহণ না করার কারণে এবং মামলায় সত্যতা না পাওয়ায় ৮৮ শতাংশ মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ এসব মামলায় আসামি ও তার পরিবার তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সাজা হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ মামলায়। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সালের মে মাসে বিচারপ্রক্রিয়া শেষে নিষ্পত্তিকৃত ১৬৫৬টি মামলার মধ্যে ১৩৯৩টিতে আসামিরা খালাস পেয়েছেন। সাজার রায় হয়েছে মাত্র ১৯৩টি মামলায়। অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭০টি মামলা। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, এমনকি পুলিশ আক্রমণের মতো মামলায়ও সাজার হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। ধর্ষণের ২৮টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ২৭টিতে খালাস পেয়েছেন আসামিরা। সাজা হয়েছে মাত্র ১টি মামলায়। নারী নির্যাতনের ৯৮টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে আসামিরা খালাস পেয়েছেন ৯৬টিতে। সাজা হয়েছে মাত্র ২টি মামলায়। মে মাসে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত ১০২৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে আসামিরা খালাস পেয়েছেন ৮২৮ মামলায়। সাজা হয়েছে ১৪৭টিতে। অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২টি মামলায়।