
দীর্ঘদিন ধরে চলা পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে ‘সহানুভূতির নম্বর’ দেওয়ার প্রথা থেকে বেরিয়ে আসছে সরকার। এবার থেকে ২৮ নম্বর পেলে ৩৩ করে পাস করিয়ে দেওয়া কিংবা গ্রেড পরিবর্তনের জন্য ২ থেকে ৫ নম্বর পর্যন্ত ‘সহানুভূতির’ নম্বর দেওয়ার অলিখিত নির্দেশনা আর থাকছে না। অপ্রাসঙ্গিক উত্তর লিখলে নম্বর দেওয়ার প্রথাও বাতিল হচ্ছে।
শিক্ষার প্রকৃত মান যাচাই ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে বাস্তবসম্মত করতে এই কড়াকড়ি। ফলে চলতি বছর থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর সংখ্যা কমে যেতে পারে—এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় দশক ধরে খাতা মূল্যায়নে উদারনীতির কারণে দেশে পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর থেকে খাতা মূল্যায়নে উদার হওয়ার চর্চা ব্যাপকতা পায়। পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, খাতায় কিছু লেখা থাকলেই যেন নম্বর দেওয়া হয়। এতে পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর উল্লম্ফন ঘটে। শিক্ষার সার্বিক মান নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্ন ওঠে। সরকার এতে কর্ণপাত করেনি।
একজন প্রধান পরীক্ষক কালবেলাকে জানান, অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক ও ভুল উত্তরের জন্যও নম্বর দেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘হাজী মুহম্মদ মুহসীনকে কেন দানবীর বলা হয়?’ এই প্রশ্নের উত্তরে একজন শিক্ষার্থী লিখেছিল, ‘তিনি দানব ও বীর ছিলেন, তাই তাকে দানবীর বলা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, সেই উত্তরের জন্যও পরীক্ষক নম্বর দিয়েছিলেন।
শিক্ষাবিদরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, দেরিতে হলেও পাসের হার বাড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে এসে সঠিক মূল্যায়নের পথে হাঁটা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এতে শিক্ষার প্রকৃত মানোন্নয়ন ঘটবে। পরীক্ষার ফলে কিছুটা পতন হলেও শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পরীক্ষার ফলে সংখ্যাগত অর্জনের চেয়ে গুণগত মানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এজন্য খাতা মূল্যায়নে শিক্ষকদের ‘সঠিক নম্বর’ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ‘জিপিএ ৫ পেয়ে একজন ছাত্র যখন ভালো মানের একটি কলেজে ভর্তির সুযোগ না পায়, তখন সেই ফলের কোনো মূল্য থাকে না। সেজন্য আমরা এখন মানের দিকে নজর দিচ্ছি। সংখ্যার চেয়ে গুণগত দিকটা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাবোর্ডগুলোকে পরীক্ষকদের মানসম্মত মূল্যায়নের নির্দেশনা দিতে বলা হয়েছে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির কালবেলাকে বলেন, ‘খাতা মূল্যায়নে উদারনীতি কিংবা কঠোরনীতি—কোনোটাই নয়, আমরা বাস্তবধর্মী ও সঠিক মূল্যায়নের ওপর জোর দিচ্ছি। বেশি পাস কিংবা জিপিএ ৫ দেখানোর লক্ষ্য নয়, বরং ভালো মানের শিক্ষার্থী তুলে আনাই আমাদের লক্ষ্য। সে অনুযায়ী আমরা পরীক্ষকদের নির্দেশনা দিয়েছি।
১৯৯১ সালে বুয়েটে প্রথম গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হলেও ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় তা প্রবর্তন করা হয়। ডিভিশন পদ্ধতিতে ফার্স্ট, সেকেন্ড বা থার্ড ডিভিশন, স্টার মার্ক এবং প্রতিটি বিষয়ে ৮০ বা তার বেশি নম্বরে লেটার মার্ক পাওয়ার বিধান বাতিল হয় ২০০১ সালে। ওই বছর থেকে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়। যেখানে ৮০ নম্বরের ওপরে সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ ৫ বা এ+ ধরে ৭টি গ্রেডে ফল প্রকাশ করা হয়। এরপর প্রতি ১০ নম্বরের ব্যবধানে একটি গ্রেডে বদল ধরা হয়। সর্বশেষ ৩৩ নম্বরের নিচে যারা পায়, তাদের ফেল বা এফ গ্রেড ধরা হয়।
গত দেড় দশকে খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি অন্তত তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। যার মধ্যে গ্রেডিং পদ্ধতি, এসবিএ (স্কুলভিত্তিক মূল্যায়ন) এবং ধারাবাহিক মূল্যায়ন ছিল। ২০০৭ সালে চালু হওয়া এসবিএ পদ্ধতি শিক্ষকদের দুর্নীতির কারণে এক বছরের মধ্যেই স্থগিত করা হয়। ২০২২ সালে ধারাবাহিক মূল্যায়ন চালু হলে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয় এবং ৫ আগস্টের পর তা বাতিল করে সরকার।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিঞা মো. নুরুল হক কালবেলাকে বলেন, আমি সারা দেশ ঘুরে ঘুরে শিক্ষকদের বলছি, ফলে পাসের হার বা জিপিএ ৫ বাড়ানোর কোনো চাপ নেই। আমরা চাই প্রকৃত মূল্যায়ন হোক। শিক্ষার্থীর প্রাপ্য নম্বরই সে পাক—এতে কোনোরকম উদারতার সুযোগ নেই। উদারনীতির নামে এতদিন যে মূল্যায়ন হয়েছে, তা আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে সংখ্যা নয়, গুণগত মানই হচ্ছে এখনকার প্রধান লক্ষ্য।
পাসের হারে ঊর্ধ্বগতি: ২০০১ সালে গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেই বছর পাসের হার ছিল ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। দুই দশকের ব্যবধানে ২০২১ সালে তা ৯৩.৫৮ শতাংশে ওঠে। এর পেছনে প্রধানত উদারনীতিকেই কারণ মনে করা হয়। বোর্ডভিত্তিক ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৬, ২০২১ ও ২০২২ সালে পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৮৯.০৩ শতাংশ, ৯১.৩৪, ৮৮.২৯, ৯৩.৫৮ ও ৮৭.৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৯৩.৫৮ শতাংশ পাসের হার রেকর্ড করা হয়। বিগত এক দশকের মধ্যে ২০১৮ সালে পাসের হার ছিল সর্বনিম্ন, ৭৭.৭৭ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১০, ২০১২ ও ২০১৯ সালেও পাসের হার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।
জিপিএ-৫-এর উল্লম্ফন: বিগত দুই দশকের পরিসংখ্যান বলছে, সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ ৫-এর উল্লম্ফন ঘটেছে। ২০০১ সালে যেখানে মাত্র ৭৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছিল, সেখানে ২০২২ সালে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জনে।