Image description

ঝালকাঠির মাটি বরাবরই বিএনপির শক্তিশালী দুর্গ। দক্ষিণাঞ্চলের এই জেলায় ধানের শীষের ভোটই বেশি। বার বার জনগণের ভোটে তা প্রমাণও হয়েছে। তবে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আধিপত্য থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান স্থানীয়রা।

গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা দলগুলো সমন্বয় করে প্রার্থী দেবে। এটি ঘটলে ভোটের মাঠে বিএনপি প্রার্থীরা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

জেলার চারটি উপজেলা নিয়ে দুটি সংসদীয় আসন গঠিত হয়েছে। উভয় আসনেই বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা দেড় ডজনের বেশি। বিপরীতে জামায়াত দিয়েছে একক প্রার্থী। তবে সেটাও চূড়ান্ত নয় বলে জানা গেছে। কেউ কেউ বলছেন এগুলো ‘ডামি’ প্রার্থী। ভোটের মাঠে লড়ার জন্য নমীনি দেওয়া হবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা শেষ হওয়ার পর। এরপর তুলনা করা যাবেÑ কার চেয়ে কে বেশি শক্তিশালী ও ভোটের মাঠে প্রভাব কার বেশি থাকবে।

ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া)

রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটিতে তৎপর আছেন বিএনপির আট নেতা। তারা সবাই দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাদের মধ্যে বেশি আলোচনায় আছেনÑ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল, নিউ ইয়র্ক দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিবুর রহমান সেলিম রেজা ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম আজম সৈকত।

এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা রফিক হাওলাদার, জাতীয়তাবাদী গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার একেএম রেজাউল করিম, জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী পরিষদের সহ-সভাপতি ও রাজাপুর উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা ড. জাকারিয়া লিংকন, সদ্য বিএনপিতে যোগ দেওয়া কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হক প্রচারের মাঠে সরব।

তারা সবাই নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতার জানান দিচ্ছেন। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের দোয়া ও সমর্থন কামনা করছেন। এলাকায় ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন বলে তারা দাবি করছেন।

তাদের মধ্যে প্রচারে এগিয়ে আছেন বিএনপি নেতা রফিকুল। ২০০৮ সালে ধানের শীষ নিয়ে পরাজিত হন। একই পরিণতি হয় ২০১৮ সালে। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে গিয়ে জেল জুলুম-হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। দলের দুর্দিনে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। তাই আমি মনে করি দল এবার আমাকে মনোনয়ন দিয়ে এই ত্যাগের মূল্যায়ন করবে।’

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হাবিবুর বলেন, ‘দেশের বাইরে অবস্থান করলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সর্বদা জাগ্রত ও সক্রিয় ছিলাম। এ কারণে বিভিন্ন সময় রোষানলেও পড়ি। দেশে পরিবারের লোকজনকেও হয়রানির শিকার হতে হয়। আশা করি, নিরাশ করবে না।’

ইঞ্জিনিয়ার রেজাউল বলেন, একযুগ ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণসহ জনসেবামূলক বিভিন্ন কাজ করে জনগণের মন জয় করেছি। এরপরও চারবার দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হই। এবার আশা করি দল আস্থা রাখবে।

অপরদিকে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। দলের রাজাপুর উপজেলা শাখার সাবেক আমির ও বর্তমান জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা হেমায়েত উদ্দিনকে মনোনয়ন দেওয়ায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। তার পক্ষে জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজ, স্বেচ্ছাশ্রম ও অর্থায়নে বিভিন্ন ইউনিয়নে রাস্তা ও সেতু সংস্কারসহ সামাজিক কাজ করে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে দলটি।

মাওলানা হেমায়েত বলেন, ‘জনগণ আমাকে ভোট দেবে না, ইসলামী হুকুমাত কায়েম করার জন্য দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেবে।’

জামায়াত তৎপর থাকলেও এখনো পর্যন্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য ইসলামী দল এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অন্য দলগুলো। তবে জামায়াতের সঙ্গে জোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। সে ক্ষেত্রে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ড. ফয়জুল হককে জামায়াতসহ অন্য দলগুলো সমর্থন দিতে পারে।

ঝালকাঠি-২ (সদর ও নলছিটি)

সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটিতে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্তত আটজন। তাদের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য জীবা আমিনা আল গাজী, সাবেক এমপি ও জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাত হোসেন, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম নূপুর ও সৌদি আরব পশ্চিম বিএনপির সদস্য সচিব মীর মনিরুজ্জামান তপন জোর প্রচার চালাচ্ছেন।

২০০৮ সালে বিএনপির মনোনয়ন পান ইলেন ভুট্টো। তিনি সে যাত্রায় পার হতে না পারলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে পাস করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালেও দলের টিকিট পান তিনি। তবে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে বিএনপির পতাকা দেওয়া হয় জীবা আমিনার হাতে।

গত ৫ আগস্টের পরে বিএনপির রাজনীতিতে ইলেন ভুট্টো নতুন করে তৎপর হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাদের অভিযোগ, ইলেন ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। এরপর তাকে কেউ খুঁজে পায়নি। আওয়ামী জামানায় তার নামে হয়নি কোনো মামলাও।

জীবা আমিনা বলেন, ‘২০১৮ সালে নির্বাচনী প্রচারে নামায় বাড়িতে হামলা হয়, সন্ত্রাসীরা গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর বিভিন্নভাবে হামলা-মামলা দিয়ে নির্যাতন ও হয়রানি করে ফ্যাসিবাদী সরকার। এতকিছুর পর নেতাকর্মীদের আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। এবার দল তার প্রতিদান দেবে বলে প্রত্যাশা রাখি।’

মাহবুবুল হক বিগত দিনে ঢাকার আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। তিনি একাধিকবার কারাবরণও করেন। নির্বাচনের মাঠে লড়ার ইচ্ছা তার বহু আগের, বেশ কয়েকবার তিনি দলের মনোনয়নও চান। এবারও তিনি আশাবাদী বলে জানিয়েছেন।

২০২০ সালে জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠনের পর থেকে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাত হোসেন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তার নামে একাধিক মামলাও হয়েছে। তার বাসায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হামলা করে ভাংচুর চালায়।

দলের আরেক ত্যাগী নেতা মনিরুলও মনোনয়ন পাওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাহিদার আলোকে রাজনীতি করছি। এবার দল আমাকে টিকিট দেবে বলে আশা রাখি।

মীর মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি প্রবাসে দলের দুঃসময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করি। জুলাই বিপ্লবেও আমরা রেমিট্যান্স বন্ধসহ ফ্যাসিবাদের উপর চাপ তৈরি করতে নানা পদক্ষেপ নেই। এখন নিজ এলাকার মানুষের সেবা করতে চাই। তাই এবারে আমি দলীয় মনোনয়ন চাইব।’

এদিকে বার বার কারা নির্যাতিত ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য ব্যারিস্টার এম জি জাকারিয়াও এবার বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন। গত ১৫ বছরে তার নামে আওয়ামী লীগ ৪৫টি মামলা দিয়েছিল বলে তার দাবি।

ঝালকাঠি শহরের সাধারণ ভোটার শামীম আহসান বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর এটিই প্রথম জাতীয় নির্বাচন। তাই এর গুরুত্ব অনেক। ভোটাররা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার জন্য। তবে এবারের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তরুণ ভোটাররা। দেশ যেন আবার নতুন ফ্যাসিবাদের কবলে না পড়ে সে বিষয়ে সবাই বেশ সচেতন।

রাজাপুরের তরুণ ভোটার রাব্বী তালুকদার বলেন, ‘তরুণরা এবার যেদিকে ঝুঁকবে নির্বাচনে শেষ হাসি তারাই হাসবে। এই প্রথম স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবÑ এটাই পরম তৃপ্তির।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের ঝালকাঠি শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আক্কাস সিকদার বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে দলগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে তারা নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন। আবার যদি চাঁদাবাজ, দখলদার, দুর্নীতিগ্রস্ত ও টেন্ডারবাজরা ক্ষমতায় আসে, তাহলে জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।