Image description

আজ ২৬ জুন, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। প্রতি বছর এ দিনটি বিশ্বজুড়ে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধে পালিত হয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। তবে মাদকের অপব্যবহার দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দেশীয়দের পাশাপাশি বিদেশিরাও এতে সক্রিয়। বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সহজলভ্য ছিল। সরকারি নিবন্ধিত দোকান থেকে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে গাঁজা ও আফিম বিক্রি হতো। ১৯৮০ সালে গাঁজা নিষিদ্ধ হলে তার জায়গা নেয় হেরোইন। তবে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও গাঁজার বাজার আরও বিস্তৃত হয়। এরপর ফেনসিডিল নামক কাশির সিরাপ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, যা ভারত থেকে বাংলাদেশে আসত। ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি ছিল সবচেয়ে ব্যবহৃত মাদক। বর্তমানে দেশের আনাচে-কানাচে এখনও ফেনসিডিল পাওয়া যায়।

২০০০ সালের পর মিয়ানমার থেকে সিন্থেটিক ড্রাগ বাংলাদেশে আসতে শুরু করে, যা ২০০৫ সালের পর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে ড্যান্ডি নামক সস্তা মাদকের ব্যবহার বাড়ে, যা প্রধানত পথশিশুরা সেবন করে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ক্রিস্টাল মেথ, ইয়াবা, এলএসডি, ডিওবি, এমডিএমএর মতো মাদকের ব্যবহার বহুগুণে বেড়েছে। অনলাইন মাধ্যম এ বিস্তারকে আরও সহজ করেছে। এখন কিশোর ও শিশুদের মধ্যেও মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ছে।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত নেয় প্রতি বছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করা হবে। মাদকের অপব্যবহারের যে বিস্তার ঘটেছে, তা সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকি। এই প্রেক্ষাপটে মানুষকে সচেতন করতে দিবসটি পালন করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মাদক কারবারি ও সিন্ডিকেট সদস্যদের তৎপরতা সম্প্রতি আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বৈঠকে এ চিত্র উঠে আসে। মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরকে।

নতুন তালিকা তৈরি এবং পুরনোদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারকে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক মাদক কারবারি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ পকেটমার বা রিকশাচালক থেকে মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যে পরিণত হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ কোকেন পাচারের রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি ৮.৫ কেজি কোকেন উদ্ধার হয়। এই ঘটনায় মালাউই, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের আটজনকে আটক করা হয়।

এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ মাদক চোরাচালানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ার তিনটি মাদক চোরাচালান এলাকা—গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল (মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান), ও গোল্ডেন ওয়েজ (ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের অংশবিশেষ)—সবগুলোর মধ্যেই বাংলাদেশ পড়ে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ জানিয়েছেন, “দেশ থেকে মাদক নির্মূল করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পুলিশ ও র‍্যাবের পাশাপাশি আমাদের অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। আজ মাদকবিরোধী র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান হবে, যেখানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।”

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক ব্যবসা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীরা মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। সীমান্ত এলাকার থানাগুলোর অনেক পুলিশ সদস্যও এতে জড়িত। বিশেষ করে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে মাদক কারবারিদের তৎপরতা বেশি।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক ডিআইজি জানিয়েছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে মাদকবিরোধী অভিযানে কিছুটা শিথিলতা এসেছে। এ সুযোগে মাদক কারবারিরা পুনরায় সক্রিয় হয়েছে। তবে অভিযান থেমে নেই, বরং আরও জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাদক আস্তানা ধ্বংস করতে হবে, পুরনো-নতুন কারবারিদের তালিকা করতে হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

গতকাল বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৩২টি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের মাঝে আর্থিক অনুদানের চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “আমাদের দুটি বড় শত্রু—দুর্নীতি ও মাদক। মাদক থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যায়, তা নিয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। মাদক শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমস্যা নয়, এটি আমাদের সবার সমস্যা। স্কুলপড়ুয়া শিশুদের মধ্যেও মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাময়ের খরচ অনেক বেশি, যা গরিবরা বহন করতে পারে না। আমি চাই, এমন এক সমাজ গড়ে উঠুক যেখানে কাউকে নিরাময় কেন্দ্রে যেতে না হয়।”

তিনি আরও বলেন, “সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে মাদক উৎপাদিত হয়, এবং সেখান থেকে চেইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে। এই সমস্যা দীর্ঘদিনেও সমাধান হয়নি। একসময় ফেনসিডিল শিশুদের পেটে ব্যথা হলে খাওয়ানো হতো, বোতলে সাপের ছবি থাকত। আমি বিজিবি সদস্যদের বলতাম, যদি আজ ১০০-২০০ টাকায় এসব পণ্য ঢুকতে দাও, কাল সেটা তোমার পরিবারের কেউ খেতে পারে—তখন বোঝবে এর ভয়াবহতা।”
শীর্ষনিউজ