Image description

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রাণভোমরা বলা হয় গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি)। ৫ আগস্টের পর ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো ‌‘ইমেজ’ সংকটে ভুগছে ডিবি। ১০টি বিভাগের ৬টিই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। অন্য বিভাগেও নানা সংকট রয়েছে। ২ মাস ধরে ফাঁকা ডিএমপির ডিবি প্রধানের পদটি। বর্তমানে একজন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার অতিরিক্ত রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি), অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) ও সহকারী পুলিশ কমিশনারের (এসি) অনেক পদ ফাঁকা পড়ে আছে। 

যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের একটি বড় অংশ তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা কার্যক্রমে দক্ষ নন। এলআইসি (লফুল ইন্টারসেপশন বা ফোনে আড়িপাতা) সম্পর্কিত কার্যক্রমে অভ্যস্ত নন অনেকে। এছাড়া এনটিএমসির সহায়তার জন্য সিটিটিসির মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে ডিবিকে। এতে আসামি শনাক্ত ও অপরাধীদের অপতৎপরতা ঠেকাতে বেগ পেতে হচ্ছে এই শাখাটিকে।

এদিকে ডিবিতে নেই কোনো নারী ক্যাডার কর্মকর্তা। ফলে অনেক নারী ভিকটিম, বিশেষ করে সাইবার ক্রাইমের শিকার নারী সুরাহা পেতে ডিবিতে এসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। গুরুত্বপূর্ণ কোনো নারী আসামি গ্রেফতার করলে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্স থেকে নারী কর্মকর্তা ‘হায়ার’ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে ডিবির কয়েকজন কর্মকর্তা নিরলস পরিশ্রম করলেও নগরবাসী পাচ্ছেন না পূর্ণাঙ্গ সেবা। পদ ফাঁকা থাকার বিষয়ে ডিএমপির শীর্ষ কর্তাদের ভাষ্য, সারা দেশেই এএসপির (সহকারী পুলিশ সুপার) সংখ্যা কমে গেছে। নতুন নিয়োগও আটকে যাওয়াতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

 

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিবির যে পদগুলো খালি আছে সিদ্ধান্ত হয়েছে অচিরেই সেগুলো পূরণ করা হবে। ডিবিতে হারুন (সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ) যে কাজ করেছে আমরা ওইসব করব না।’

সূত্র বলছে, রাজধানীতে মাঝে মধ্যেই সংঘটিত হওয়া বড় বড় অপরাধের আগাম তথ্য পাচ্ছে না ডিবি। ফলে দিনে দিনে ভুক্তভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি ও মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা ব্যাপক আকারে বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে আছে নগরবাসী। এমন বাস্তবতায় খোদ ডিবির কর্মকর্তারাই বলছেন, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর ডিবি অপরাধী গ্রেফতারে সফলতা পেলেও প্রিভেন্টিভ পুলিশিংয়ে যেতে পারছে না। অর্থাৎ অপরাধ সংঘটনের আগে তা প্রতিরোধ করতে ডিবির নেওয়া কার্যক্রম পর্যাপ্ত নয়। এর কারণ হিসাবে ওইসব কর্মকর্তারা বলছেন, জনবল সংকট এবং ৫ আগস্ট পরবর্তী ডিবিতে দায়িত্ব পাওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তা নবিশ। তাদের এ ধরনের কাজের অতীত অভিজ্ঞতাও নেই।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে ১০টি বিভাগ রয়েছে। রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয় হলেও প্রতিটি বিভাগের সদস্যরা মাঠপর্যায়ে নিজ নিজ এলাকার অপরাধমূলক কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে প্রিভেন্টিভ পুলিশিং ও অপরাধী গ্রেফতার করা ডিবির প্রধান কাজ। ডিবির প্রতিটি বিভাগে রয়েছে আলাদা টিম। ইন্সপেক্টর, এসআই ও কনস্টেবলদের সমন্বয়ে একেকটি টিম গঠিত হয়। এসব টিমের ইনচার্জ থাকার কথা এডিসি ও এসি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের।

ডিএমপির অপরাধের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, অপরাধপ্রবণ এলাকার মধ্যে অন্যতম মিরপুর বিভাগ। অথচ ডিবির মিরপুর বিভাগে সহকারী কমিশনারের (এসি) দুটি পদই শূন্য। অতিরিক্ত উপকমিশনারের (এডিসি) তিনটি পদ থাকলেও আছেন দুজন কর্মকর্তা। এভাবেই চলছে মাসের পর মাস। ডিবির এ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘জনবল কম হওয়ায় কাজ করতে একটু সমস্যা হচ্ছে। এই সীমিত জনবল নিয়েই কাজ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি।’

ডিএমপির সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এলাকা তেজগাঁও বিভাগ। এ বিভাগের অধীনে রয়েছে মোহাম্মদপুর, হাতিরঝিল, আদাবর, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা। অথচ ডিবির এ বিভাগের নেই কোনো নিয়মিত ডিসি। ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ-উত্তরের এডিসি (অ্যাডমিন) মোহাম্মদ রাকিব খানকে তেজগাঁও বিভাগের ডিসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এডিসির তিনটি পদ থাকলেও আছেন একজন কর্মকর্তা।

ডিবি রমনা বিভাগেও নেই নিয়মিত ডিসি। এডিসি মো. ইলিয়াস কবিরকে ডিসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এডিসির তিনটি পদই ফাঁকা।

লালবাগ বিভাগে নিয়মিত ডিসি হিসাবে রয়েছেন মো. মোস্তাক সরকার। তার বিভাগে এডিসির একটি এবং এসির একটি পদ ফাঁকা। টেনেটুনে চলা এ বিভাগের ডিসিকে আবার গোয়েন্দা ওয়ারী বিভাগের ডিসির (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওয়ারী বিভাগে এডিসির দুটি ও এসির একটি পদ ফাঁকা। এমন বাস্তবতায় কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারছেন-এমন প্রশ্নে ডিসি মোস্তাক সরকার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’

ডিসি মো. কামরুল হাসানকে ডিবি গুলশান ও ডিবি উত্তরা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গুলশান বিভাগে একটি এডিসির পদ ফাঁকা। এছাড়া উত্তরা বিভাগে সহকারী কমিশনারের (এসি) দুটি পদই ফাঁকা। সম্প্রতি উত্তরাতে র‌্যাব পরিচয়ে প্রকাশ্যে নগদের ডিস্ট্রিবিউটরের কোটি টাকা লুটসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এছাড়া ডিবি মতিঝিল বিভাগে এডিসির একটি পদ ফাঁকা। সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ-উত্তরের এডিসির একটি ও এসির সবকটি পদ ফাঁকা। সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ-দক্ষিণের দুটি এডিসি পদ ফাঁকা।

ডিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ডিবির কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ থাকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সঙ্গে। সেখানে ধারণকৃত কলরেকর্ড শোনার মতো জনবলও নেই। এছাড়া এনটিএমসির তথ্য পেতে ডিবিকে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে। এনটিএমসির সঙ্গে কাজ করার মতো দক্ষ জনবলও এই মুহূর্তে ডিবিতে নেই।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ডিবিতে থাকা কিছু কর্মকর্তা আগে থেকে নেটওয়ার্ক অ্যানালাইসিসের কাজে অভিজ্ঞ হলেও বেশির ভাগই একেবারেই অনভিজ্ঞ। গত ১০ মাসে একজন কর্মকর্তাও প্রযুক্তি সম্পর্কিত দেশীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। ফলে এলআইসি (ল-ফুল ইন্টারসেপশন বা ফোনে আড়িপাতা) সম্পর্কিত কার্যক্রমে অভ্যস্ত আছে বা ভালো কাজ জানে-এমন কর্মকর্তা যুক্ত না হলে ডিবির কাজের গতি দ্রুত হারাবে। একই সঙ্গে ডিবি কর্মকর্তাদের কাজের দক্ষতা বাড়াতে পর্যাপ্ত ইন-হাউজ ও অ্যাডভান্স প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ফান্ড ও হাই টেকনোলজি রিলেটেড ইকুইপমেন্ট দরকার।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) ফারুক আহমেদ বলেন, সারা দেশেই এএসপির সংখ্যা কমে গেছে। পিএসসির নিয়োগও আটকে গেছে। এর ফলে সারা দেশেই সংকট দেখা দিয়েছে। পুলিশে নারীর সংখ্যাও কম। আনুপাতিক হারে নেই। এরপরও আমরা চেষ্টা করছি নারী অফিসার দেওয়ার। তিনি বলেন, ডিবি মানেই একটা আতঙ্ক ছিল। সেখান থেকে বের হয়ে ডিবি যে জনগণের আস্থার জায়গায় আসে সেজন্য পুরাতন জনবল, যাদের দেখলেই মানুষ অবিশ্বাস করত তাদের বের করে দিয়েছি। নতুন কিছু লোক আমরা নিয়ে এসেছি। এরা অনেক ক্ষেত্রে অবহেলিত ছিল এবং পুলিশের কাজকর্ম ও প্রশিক্ষণ থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। তাদের পর্যাপ্ত দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিচ্ছি।