
গতিহীন হয়ে পড়েছে পতিত আওয়ামী লীগ আমলের তিন উন্নয়ন প্রকল্প। সঠিকভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করাসহ যেনতেনভাবে প্রকল্প গ্রহণের কারণে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে বেড়েছে মেয়াদ ও ব্যয় এবং আবারও বাড়ার শঙ্কা আছে। সেই সঙ্গে সঠিক সময়ে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসেনি। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণে উঠে এসেছে এমন চিত্র। প্রকল্পগুলো হলো-‘গ্রামীণ মাটির রাস্তা টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিং বন্ড (এইচবিসি) করণ’, ‘বিসিকের ৮টি শিল্পনগরী মেরামত ও পুনর্নির্মাণ’ এবং ‘৭টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন ও নতুন ৬টি স্থাপন প্রকল্প’।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, গত সরকারের সময়ে প্রকল্প গ্রহণে তেমন সতর্কতা ছিল না। যে যার মতো করে প্রকল্প নিয়েছে। আইএমইডি অনেক সময় মূল্যায়ন করে নানা অনিয়ম তুলে ধরলেও তেমন কাজ হয়নি। তবে যে কোনো প্রকল্পই সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন না হলে তার মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা অবশ্যই থাকে। কেননা বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যেসব ম্যাটেরিয়াল লাগে সেগুলোর দাম বাড়ে। তখন প্রকল্প সংশোধন করতে হয়। এভাবে অর্থের অপচয় ঘটে। আবার যে সময় সুফল পাওয়ার কথা সেটি মেলে না। সময়েরও অপচয় হয়। পাশাপাশি সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রকল্পের গুরুত্বও হারিয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
আইএমইডি জানায়, প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়নে মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল মোট ৩ হাজার ৭৭৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এখন ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি ৯ লাখ টাকায়। এক্ষেত্রে সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাড়তি ব্যয় হবে ৬৮৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। এগুলোর বাস্তবায়নে গড় মেয়াদ ছিল ২ বছর ২ মাস। কিন্তু প্রতিটি প্রকল্পে মেয়াদ বেড়েছে গড়ে ৩ বছর ৫ মাস করে।
সংস্থাটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘গ্রামীণ মাটির রাস্তা টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিং বন্ড (এইচবিসি) করণ’ প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত আড়াই বছর। কিন্তু দুদফায় মেয়াদ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত করা হয় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। এক্ষেত্রে সময় বেড়েছে ৩ বছর। মোট সাড়ে ৫ বছরেও কাজ শেষ হয়নি। গত মার্চ মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক ব্যয় ৮৯ দশমিক ২ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ পর্যায়ে এসে মেয়াদ শেষ হওয়ায় ফের সময় বৃদ্ধি করা হতে পারে। এদিকে প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩৪৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৪ হাজার ৩৪৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে বাড়তি খরচ যাচ্ছে ৯৯৭ কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ায় শেষ পর্যন্ত ব্যয়ও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। প্রকল্পটির দুর্বল দিক সম্পর্কে আইএমইডি বলছে, রাস্তা হেরিং বন্ডকরণে প্রস্থ ৩ মিটার থাকলেও ক্ষেত্র বিশেষে প্রস্থ ৩ মিটারের কম অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া হেরিং বন্ড করার আগে রাস্তার সাবগ্রেড কমপ্যাকশন (মাটি বসানো) যথাযথভাবে না করায় শতকরা ১০ ভাগ স্থানে আংশিক মাটি দেবে গেছে। প্রকল্পটির পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়নি। পাশাপাশি প্রকল্পের এক্সিট প্ল্যান না থাকায় রাস্তা তৈরির পর যথাযথ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা থাকছে না।
এদিকে ‘বিসিকের ৮টি শিল্পনগরী মেরামত ও পুনর্নির্মাণ’ প্রকল্পটির মূল মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ বছর। পরে দফায় দফায় ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ বছর বাড়ানো হয়। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট সময় যাবে ৬ বছর। পাশাপাশি প্রকল্পের মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৭৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা। সেখান থেকে ৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরশেন (বিসিক)। প্রকল্পের আওতায় ময়মনসিংহ, জামালপুর, নরসিংদী, কুমিল্লা, কক্সবাজার, সিলেট, সাতক্ষীরা ও বগুড়া শিল্পনগরী মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময় চলে গেলে ৫ বছর ৪ মাস। এ সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৭৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং আর্থিক ৫৯ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে এটির মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলো হলো-অসম্পূর্ণ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, নকশায় অসম্পূর্ণতা, ক্রয় প্যাকেজ বিভাজনে ত্রুটি, প্রকল্প পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং ক্রয় প্রক্রিয়া ও পুরোনো অবকাঠামো অপসারণে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
‘৭টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন ও নতুন ৬টি স্থাপন প্রকল্পটির মূল মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছর। কিন্তু দফায় দফায় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় বেড়েছে সাড়ে ৩ বছর। গত মার্চ মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ২৫ তাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতায় বস্ত্র অধিদপ্তর।
এদিকে প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৩৫৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। পরে জমি অধিগ্রহণ পরিমাণ কমানোর কারণে ১৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা কমিয়ে মোট ব্যয় ধরা হয় ৩৩৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এটির দুর্বল দিকগুলো হলো-ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ ও পিডব্লিউডির সঠিক দায়িত্ব পালন না করা, প্রকল্প নেওয়ার আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করা, প্রকল্পের আওতায় কেনা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) কোনো দিকনির্দেশনা না থাকা।