সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আর পাল্টাপাল্টি দোষারোপের কারণে তদন্ত রিপোর্টে কী উঠে আসে সেটি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল অনেকের।দু’দিকের আলাদা কক্ষে আগুন লাগা, কুকুরের মৃতদেহ, অগ্নি নির্বাপনে বিলম্বের কারণ এবং সাদা পাউডারের উপস্থিতির মতো বিষয় সামনে এনে জনমনে সন্দেহ এবং জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। এসব প্রশ্নকে সামনে রেখেই সচিবালয়ের আগুন নাশকতামূলক কি না সে প্রশ্ন ওঠে।মঙ্গলবার সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেয়া প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সচিবালয়ে আগুনের কারণ বৈদ্যুতিক ‘লুজ কানেকশন’। ভবনটির ছয়তলার মাঝামাঝি সিঁড়ির কাছে এটি শুরু হয়। সচিবালয়ের ভেতর সিসি ক্যামেরার ফুটেজেও ২৬ ডিসেম্বর রাত ১টা ৩৬ মিনিটে একটি বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকে ধীরে ধীরে আগুনের বিষয়টি ধরা পড়েছে।সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় মধ্যরাতে আগুনের ঘটনার শুরু থেকেই নাশকতার সন্দেহ করা হয়। এই সন্দেহের পেছনে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে। আগুনের উৎস এবং কারণ অনুসন্ধানে স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার।সচিবালয়ের আগুনের ঘটনা তদন্ত করে আলোচিত পাঁচটি প্রশ্নে কী উত্তর মিলেছে তা জানতে তদন্ত কমিটির দু’জন সদস্যের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। দুই সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল এবং ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক।
দু’দিকে কেন আগুন
সচিবালয়ের আগুন নিয়ে যে প্রশ্ন সবাই তুলেছেন সেটি হলো ভবনের দু’দিকে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে আগুন কেন। আগুন লাগার পর যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেখানে সচিবালয়ের সামনে থেকে সাত নম্বর ভবনটির দক্ষিণ দিক দেখা যায়। সেখান থেকে ভবনের পূর্ব ও পশ্চিমপাশে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ড. মো: ইয়াছির আরাফাত খান বলেন আগুনের এই ছবি অনেক পরের দিকে রেকর্ড করা।তিনি বলেন, ‘স্যাবোটাজকে সামনে রেখে এটা বলা হচ্ছিল যে বিভিন্ন জায়গা থেকে তো একসাথে ফায়ার হতে পারে না। শুরু থেকেই আমরা এইটা নিয়ে কাজ করছিলাম। আমরা যখন আগুনের সূত্রপাত থেকে কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এটা অনুসন্ধান করছিলাম। তখন আপনি যেগুলোর কথা বলছেন শুরুতে কিন্তু এসব জায়গায় আগুন ছিল না। এইটা আসলে আপনার আরো আধাঘণ্টা পরের সিনারিও। তখন পুরো কোরিডোর পুড়তেছে, কিছু কিছু রুমে আগুন ঢুকে পড়ছে। যে রুমে আগুন ঢুকছে সে রুমের জানালা দিয়ে আপনি দেখতে পাচ্ছেন।’
এ বিষয়ে বুয়েটের তড়িত ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং তদন্ত কমিটির সদস্য ইয়াসির আরাফাতের কথা হলো, শুধু ওই ছবিটা দেখলে যে কারো মনে হবে এটা নাশকতা।তিনি বলেন, ‘দু’জায়গায় আমরা দেখতেছি এটাতো প্রপাগেট করার পরে। এখন ধরেন আমরা এই ইনভেস্টিগেশনটা না করে ওই ছবিটা যাকেই দেখাক সে তো বলবে, হ্যাঁ তাই তো দুই জায়গায় কেন? ওটা অ্যাডভান্স লেভেলের শুধু না, কিছুক্ষণ আগুন কন্টিনিউ করার পরের ছবি ওটা।’এখানে প্রশ্ন ওঠে আগুনের উৎস থেকে বিভিন্ন দূরত্বের রুম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কেন হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে একজন উপদেষ্টার অফিস কক্ষ রয়েছে। তদন্ত দলের সদস্যরা বলছেন, এটি দু’টি কারণে মূলত হয়েছে।প্রথমত, দু’দিকে বদ্ধ রুম থাকায় করিডোরে আগুন পূর্ব-পশ্চিমে ছুটেছে। পথে যে রুমে সহজে প্রবেশ করতে পারে এবং অতি দাহ্য বস্তু পেয়েছে সেই রুমে ঢুকেছে। এবং ওই রুমের এসি বিস্ফোরণ ঘটেছে।
দ্বিতীয়ত, সচিবালয়ের রুমগুলোর দরজা এবং ইন্টেরিয়র ভিন্ন ভিন্ন থাকায় যেটি সহজে দাহ্য সেগুলো আগে পুড়েছে। কেমিকৌশল বিভাগের ড. ইয়াছির আরাফাত বলেন, যে রুমগুলো বেশি ডেকোরেটেড সেই রুমগুলো বেশি পুড়েছে।
সাদা পাউডার এবং নাশকতার প্রশ্ন
সচিবালয়ের আগুন নেভার পর ভেতরে সাদা পাউডার জাতীয় দ্রব্যের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছিল। এছাড়া ছুটির দিনে রাতের বেলায় এ আগুন লেগে যাওয়ায় নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আলোচনায় আসে। প্রশ্ন হলো তদন্ত কমিটি কিভাবে নাশকতার বিষয়টি নাকচ করল?এ দুই প্রশ্নে তদন্ত সংশ্লিষ্ট দু’বিশেষজ্ঞ বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণে এবং কোনো বাইরের আলামত না থাকা এবং পরীক্ষাগারে টেস্ট থেকে নিশ্চিত করা গেছে যে এটা কোনো বিস্ফোরণ হয়নি এবং নিয়ন্ত্রিত ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসেরও ব্যবহার হয়নি।তড়িৎ কৌশল বিভাগের শিক্ষক ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘একটা হলো স্পার্কের পর অনেক সময় নিয়ে আস্তে আস্তে আগুনটা লেগেছে। সময় নিয়ে আগুন লাগাটা এর পেছনে একটা বড় যুক্তি আরেকটা হচ্ছে কোনো ইম্প্রোভাইস ইউনিটতো সেখানে পাওয়া যায়নি। এবং ওখানে যে যে টুলস আছে ওগুলো নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করা এবং সেনাবাহিনীর ডক স্কোয়াড কোনো কিছু এরকম পায়নি।’সাদা পাউডারের মতো যে বস্তু ভবনে পাওয়া গিয়েছিল সেটিও পরীক্ষা করেছে তদন্ত কমিটি। কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো: ইয়াছির আরাফাত বলেন, ‘সাদা ম্যাটেরিয়ালসটা কালেক্ট করা হয়েছে পশ্চিম পাশে সিড়ির একটা জায়গা থেকে। সেটা সেনাবাহিনী নিয়েছিল এবং আমাদের বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। আমরা ওইটা অ্যানালিসিস করে আসলে তেমন কিছু পাইনি। এটা চুন জাতীয় পদার্থ।’
কুকুর সম্পর্কে কী তথ্য পাওয়া যায়
সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনের যে ফ্লোরে আগুন লেগেছে ওই ফ্লোর ছয়তলা থেকে একটি কুকুরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। বন্ধ সচিবালয়ের ছয়তলায় কিভাবে কুকুর গেল সেটি একটি প্রশ্ন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা ভিডিও ফুটেজ দেখে সে বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন।সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা যায়, কুকুরটি হেঁটে এসে একটি চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়ছে। এবং অগ্নিকাণ্ডের এক পর্যায়ে সেটি জেগে ওঠে। এরপরে আর বের হতে পারেনি। কিন্তু কিভাবে ঢুকেছে সেটা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে নেই।কেমিকৌশল বিভাগের সদস্য ইয়াছির আরাফাত বলেন, ‘আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ছয়তলা ডান দিকে কর্নারের সিলিংয়ের উপরে। পশ্চিম সাইডে। কুকুরটা ছয়তলার পূর্ব সাইডে ছিল। কুকুরটাকে ৭টা ১২ মিনিটে দেখা গেছে। তার আগে আর দেখা যায়নি। তার মানে তার আগেও তারা (সিআইডি) দেখছে। কিন্তু ঠিক কখন থেকে সেটা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের সুপারিশ যেটা নেক্সট স্টেপ অফ ওয়ার্কে বলা আছে যে তার আগের ২৪ ঘণ্টার ফুটেজ দেখা যে সেখানেও কোনো আলামত পাওয়া যায় কিনা।’
আগুন নেভাতে বিলম্ব কেন
সচিবালয়ে রাত ১টা ৫২ মিনিটে আগুনের খবর পেয়ে তিন মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে বড় গাড়ি নিয়ে সচিবালয়ে ঢুকতে সমস্যা হয়েছে, এছাড়া আগুন নেভাতে পর্যাপ্ত পানির সঙ্কট ছিল।ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন আগুন নেভাতে ভেতরে ঢোকে তখন ছয়তলার পুরো করিডোরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখে।কিন্তু সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম এবং বিল্ডিং কোড অনুযায়ী অগ্নি নির্বাচন ব্যবস্থার নানা দুর্বলতা চোখে পড়েছে বুয়েটের তদন্ত কর্মকর্তাদের।বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের শিক্ষক ইয়াসির আরাফাত বলেন, আগুন শনাক্ত করা থেকে নেভানোর ব্যবস্থা এই ভবনে ত্রুটিপূর্ণ।তিনি বলেন, ‘ফায়ার ডিটেক্টর যেটা ফার্স্ট লেভেল সেটা নেই। হোসগুলা ঠিক নেই। এটা কেউ কেটে ফেলেছে কিনা সেটার জন্য বলা হয়েছে, আরো তদন্ত করে দেখা হবে। কিন্তু যেখানে ওটা আছে এদিক কাটা না হলে ওদিকে কাটা। ওনারা একটা যুক্তি দিয়েছেন যে ওগুলো কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। সেটা যাই হোক নাই তো এগুলো। তারপরে হচ্ছে বিল্ডিংয়ের হাইট অনুযায়ী ফায়ারের যে গাড়ি আসার কথা সে গাড়ি তো সচিবালয়ের মধ্যে প্রথম গেট দিয়ে ঢুকতে আটকে যায়। তো এ সমস্ত সমস্যা তো ওইখানে আছে।’
সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি মন্ত্রণালয়ের অফিস ছিল। ছয় থেকে নয়তলার চারটি ফ্লোর আগুনে পুড়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি রুম ভস্মীভূত হয়েছে। তদন্ত কমিটি জানাচ্ছে, অধিকতর তদন্তের জন্য ঘটনার আগের আরো দীর্ঘ সময়ের ফুটেজ পর্যবেক্ষণ হবে। সংগৃহীত আলামত বিদেশে পরীক্ষা হবে। এছাড়া আগুনটি বৈদ্যুতিক উৎস থেকে শুরু হয়েছিল কিনা শতভাগ নিশ্চিত হতে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হবে।
সূত্র : বিবিসি