বছরের শুরুতেই ভক্ত-অনুরাগীদের এক খবরে চমকে দিলেন সংগীতশিল্পী-অভিনেতা তাহসান খান। কোনো ধরনের পূর্বাভাস বা গুঞ্জন ছাড়াই বিয়েটা সেরে ফেলেছেন তিনি।
তাহসানের নববধূ রোজা আহমেদের পরিচয় জানতে গতকাল সকাল থেকেই মুখিয়ে ছিলেন অনেকেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে হইচই পড়ে যায়। তাহসান-রোজার বেশ কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়।
এরই মধ্যে খবর ছড়ায়, বরিশালের এক সময়ের যুবলীগ নেতা ।ফারুক আহম্মদ ওরফে পানামা ফারুক তাহসানের শ্বশুর ।২০১৪ সালে র্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন পানামা ফারুক।
স্ত্রীর পরিচয় দিতে গিয়ে তাহসান জানিয়েছেন, রোজা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী, পেশায় মেকওভার আর্টিস্ট। পড়াশোনা শেষ করে তিনি কসমেটোলজি লাইসেন্স অর্জন করে পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্কের কুইন্সে রোজাস ব্রাইডাল মেকওভার প্রতিষ্ঠা করেছেন রোজা। তার ফেসবুক পেজ ‘রোজাস ব্রাইডাল মেকওভার’ পেজে অনুসারী সংখ্যা ১২ লাখের ওপরে।
স্ত্রী রোজা আহমেদের সঙ্গে তাহসান, ডানে রোজার বাবা ফারুক আহম্মেদ ওরফে পানামা ফারুক
সেই পেজে গত ২০২৪ সালের ৪ জুন একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন রোজা, যেখানে নিজের জীবন সংগ্রাম আর বাবাকে নিয়ে আবেগঘন কথা লিখেছেন রোজা আহমেদ। ওই পোস্ট শনিবার (৪ জানুয়ারি) নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
রোজা লিখেছেন, ‘সেলফিটা একটু আগেই তুলেছি। সাধারণত আমার অনেক ছবি তোলা হয়। কিন্তু আজ এই সেলফিটা তোলার সময় চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক সময় ধরে কাঁদলাম। কিন্তু কি মনে করে কাঁদছি বা কেন কাঁদছি তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। তাই সব থেকে আদরের ছিলাম সবার। আর বাবা আমাকে সব সময় বলতেন ‘আমার ছোট্ট পরীটা কইরে’। সেই সময় বরিশাল শহরে আমাদের পরিবারের বেশ প্রভাব ছিল। ছোট বেলায় কখনো কমতি পাইনি। এর বাসায় দাওয়াত, তার বাসায় দাওয়াত আর যেতেই হবে কারণ আমাদের ছাড়া দাওয়াত অসম্পূর্ণ হবে। এমন দিন গিয়েছে দিনে ৪টা দাওয়াতেও অংশ নিয়েছি। শুধু দেখা করে আসার জন্য। ’
তিনি লেখেন, ‘হঠাৎ বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ওপারে। যতদিনের হায়াত তিনি নিয়ে এসেছেন ততোদিন ছিলেন আমাদের সাথে। অভিযোগ তো অনেক জমা আছে, বাবার সেই ছোট্ট পরীটার, কিন্তু অভিযোগ কার কাছে করব? আর বাবা শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যাননি, সাথে সাথে যে মানুষগুলো আমাদের এতো সম্মান করতেন তাদের ভালোবাসাও চলে গেল আমাদের ওপর থেকে। আর সেই দিনটাতেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, যে ভালোবাসা আমরা পেয়েছি তা সবই বাবাকে ঘিরে আর সাথে অনেক অনেক স্বার্থ। বাবা চলে যাওয়ারি ঠিক ২ মাসের মাথায় আমার এক রিলেটিভের বিয়ে। আমরা অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলাম একে ওপরের, কিন্তু বিয়েতে দাওয়াত পেলাম না। যে রিলেটিভরা সেই বিয়েতে অংশ নিয়েছে সবাই ফোন করতে শুরু করল মাকে। কেন আমরা গেলাম না, কোথায় আমরা? বরিশালে আছি কিনা এই সেই। সেদিন সারারাত বসে দেখেছি মায়ের সেই সরল মনের কান্না। আপনারা লেখাটা পড়ে ভাবতে পারেন, দাওয়াত পাইনি বলে কাঁদছি? কিন্তু দাওয়াতের জন্য নয়, একই দালানে সবাই আনন্দ করছে, আমি, মা আর ছোটো ভাই উৎস তখন বাসার এক কোণে। খুব চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, বাবা তুমি একটু দেখে যাও, যাদের জন্য এতো করেছ তারা আমাদের সব ফিরিয়ে দিচ্ছে। ’
তাহসানপত্মী আরও লিখেছেন, ‘বাবা আমাদের জন্য অনেক কিছুই রেখে গেছেন, দাদা ভাইয়ের অনেক আছে কিন্তু কিছুই গোছানো না, কে বুঝেছেন যে এতো অকালে উনি চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে! আর দাদার সব সম্পত্তিতেই চাচা-ফুফুদের ভাগ আছে। মায়ের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ পায়নি। আর আমি চলে আসি তাদের কোলে। আমার মা খুব সরল মনের, দিন-দুনিয়ার কিছুই বোঝে না। সে যে নিজের ভয়েস রেইজ করবে বা তার সেটা রেইজ করার অধিকার আছে সেটা তার ধারণার বাইরে। কখনো তার সেই সাহসটাই ছিল না যে তার শ্বশুরকে বলবে, বাবা আমাদের সম্পত্তিটুকু আমাদের বুঝিয়ে দিন। আর উৎস তো তখন অনেক ছোট। আমরা দুই ভাই-বোন তখন পিচ্চি পিচ্চি। আমাদের পড়াশোনার খরচ তখন একদম হিসাব করে টায় টায় দেওয়া হতো মায়ের হাতে। তাই কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বলতাম না যাতে উৎস যেটা চায় সেটা যাতে পায়। আমার দিক থেকে একটু কম হলেও সমস্যা নেই। ’
‘বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই প্রস্তাব আসা শুরু করে। এই রিলেটিভ একে আনে ওই রিলেটিভ ওকে আনে। সেই সময় আমি প্রথম ভয়েস রেইজ করেছি যে, আমার বয়স কম আর বাবা মারা গেছেন তো কি হয়েছে! বাবার আর আমার স্বপ্ন তো মারা যায়নি! ওই দিন কথাটায় খুব মাইন্ড করেছিল আমার কাছের লোকজন। বড়দের মুখে মুখে কথা, আমি আর মানুষ হব না। আর সেই থেকেই রটানো হয় কতো কথা। সারাদিন নাকি ছেলেদের সাথে ঘুরি, আমার বন্ধু-বান্ধব সার্কেল ভালো না, পর্দা করি না আরও কতো কি! মেয়ে তো নিশ্চয়ই প্রেম করে আর না হলে এতো ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়? আর প্রতিদিন এভাবেই বাসায় অভিযোগ আসা শুরু করে। কিন্তু আমার ভয়েস রেইজে সবাই এভাবে রিঅ্যাক্ট করবে বুঝতে পারিনি। আমার মা এতো অভিযোগ শুনতে শুনতে বললেন, তুই আমাকে ছুঁয়ে বল এসব অভিযোগ কি সত্যি? আমি মাকে ছুঁয়ে বললাম, না মা সব মিথ্যে। আমি তো স্কুল আর বাসা বাদে কোথাও যাই না। এই বলে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলাম মায়ের সাথে। ওইদিনের পর থেকে মা আমার সাথে নিয়মিত কোচিং-এ যেতেন আবার এসে বাসার সবার জন্য রান্না করতে হতো, খুব কষ্ট হয়ে যেত তার। তখন নিজের কাছে মনে হত আমি সবার জন্য একটা বোঝা, সব ক্ষেত্রেই আমার দোষ। দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে। হঠাৎ দাদাভাই অসুস্থ হয়ে পড়েন, আর সেই থেকে আমার সাথে কোচিং-এ যাওয়া বন্ধ করে দেন মা। কারণ তাদের সেবা যত্ন করতে হতো মাকেই। তখন থেকেই একা একা চলা শুরু করলাম। ’
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া তাহসান-রোজার ছবি
জানা গেছে, রোজার বাবার নাম ফারুক আহম্মেদ ওরফে পানামা ফারুক। যিনি ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন।
স্থানীয়রা জানায়, ১৯৯৩ সাল থেকে ফারুক আহম্মেদ ওরফে ‘পানামা ফারুক’ যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এলে দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে পানামা ফারুক এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায়। তবে ২০০১ সালের পর দীর্ঘ ৫ বছর পানামা ফারুক আত্মগোপনে ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলেও তাকে ওইভাবে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। তবে ২০১৩ সালের দিকে নিজের অবস্থান জানান দিতে গিয়ে আলোচনায় আসেন পানামা ফারুক।
তৎকালীন র্যাব সদস্যরা জানিয়েছিল, ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বরিশাল নগরের চকবাজার এলাকায় চেকপোস্ট বসান র্যাবের সদস্যরা। ভোর সোয়া ৬টার দিকে ওই এলাকা দিয়ে ছয়-সাতজনের একটি দল যাচ্ছিল। তাদের থামতে বললে তারা উল্টো দিকে ঘুরে চলে যেতে থাকে। র্যাবের ডিএডি নাজির আহম্মেদ তাদের থামার নির্দেশ দিলেও তারা থামেননি। এক পর্যায়ে তারা র্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে নাজির আহম্মেদ আহত হন। এ সময় আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছুড়ে। দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধের এক পর্যায়ে মারা যান ফারুক আহম্মেদ।