Image description

জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক–কর্মকর্তা–কর্মচারী ও চিকিৎসাধীন জুলাই অভ্যুত্থানের আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আহত ব্যক্তিরা চাইছেন হাসপাতাল চালু হোক। চিকিৎসক–কর্মকর্তা–কর্মচারীরা বলছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে তাঁরা কাজে যোগ দিতে চাইছেন না। এমন অবস্থায় আজ বুধবার হাসপাতালের শুধু জরুরি বিভাগ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি চোখের এই বিশেষায়িত হাসপাতাল এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ। গত বুধবার থেকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে সব ধরনের সেবা বন্ধ আছে। হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক, নার্স বা অন্য কর্মকর্তা–কর্মচারী যাচ্ছেন না। জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের দেখার জন্যও কোনো চিকিৎসক সেখানে নেই। অন্যদিকে প্রতিদিন শত শত রোগী সেবা নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফরসহ মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করেন। প্রায় তিন ঘণ্টার আলোচনা শেষে আবু জাফর সাংবাদিকদের বলেন, জরুরি বিভাগ ও সীমিত আকারে অন্য সেবা চালু করার ব্যাপারে কথা হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করবে।

হাসপাতাল বন্ধ থাকায় ফটকের সামনে বসে অপেক্ষা করেন এই নারী। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫
হাসপাতাল বন্ধ থাকায় ফটকের সামনে বসে অপেক্ষা করেন এই নারী। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

পরে মন্ত্রণালয়ে এ নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, আজ বুধবার থেকে হাসপাতালের জরুরি সেবা চালু হবে। তিনি বলেন, চারটি প্রতিষ্ঠানের চক্ষুবিশেষজ্ঞরা আহত ব্যক্তিদের চোখ পরীক্ষা করে দেখবেন কার সমস্যা কতটুকু, কাকে কোথায় চিকিৎসা নিতে হবে।

গত বুধবার সাধারণ রোগী, জুলাই অভ্যুত্থানের আহত রোগী এবং চিকিৎসক–কর্মকর্তা–কর্মচারী—এই তিন পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। পরদিন থেকে চিকিৎসক–কর্মকর্তা–কর্মচারীরা হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করেন। সাধারণ রোগীরা হাসপাতালে ছেড়ে চলে যান। এমনকি হাসপাতাল ক্যাম্পাসের বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী নেই। ব্যস্ত করিডর এখন সুনসান। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫
হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী নেই। ব্যস্ত করিডর এখন সুনসান। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এর আগে ২৫ মে জুলাই আহত চারজন বিষপান করলে তাঁদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন একজন হারপিক খান। এর পরদিন আহত ব্যক্তিদের একটি পক্ষ পরিচালকের অপসারণ দাবি করে তাঁকে অবরুদ্ধ করে। এ ঘটনার পর পরিচালক অধ্যাপক খায়ের আহমেদ চৌধুরী ছুটিতে চলে যান। পরদিন বুধবার তিন পক্ষের মারামারিতে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে অর্ধেক শয্যা নারী ও অর্ধেক পুরুষের জন্য বরাদ্দ। প্রতিদিন বহির্বিভাগে তিন হাজার থেকে আড়াই হাজার রোগী আসেন। এর মধ্যে ৪৫০ থেকে ৫০০ শিশু। প্রতিদিন গড়ে ১০০ অস্ত্রোপচার হয়। চোখে বিভিন্ন ধরনের আঘাত পেয়ে জরুরি চিকিৎসা নিতে আসে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন। এই হাসপাতালে রেটিনা, গ্লুকোমা, কর্নিয়ার বিশেষায়িত চিকিৎসা হয়। চোখের প্লাস্টিক সার্জারি হয়। সব ধরনের চিকিৎসাসেবা এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ। সারা দেশের দরিদ্র মানুষের চোখের সাধারণ ও বিশেষায়িত চিকিৎসার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল এই হাসপাতাল।

ফলোআপ হলো না

দেশের খুব কম মানুষ জানে যে হাসপাতালটির সেবা একেবারে বন্ধ আছে। তাই প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসছেন নিয়মিত। গতকাল সকাল ১০টায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দুটি ফটকই বন্ধ। ফটকের সামনে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের জটলা।

আবদুল লতিফ এসেছিলেন সাভার থেকে। ২৭ মে তাঁর চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। এক সপ্তাহ পর গতকাল ছিল ফলোআপ চিকিৎসা। কিন্তু হাসপাতাল বন্ধ। সকাল ১০টার দিকে তিনি বললেন, ‘কী করব বুঝতে পারছি না। কবে আসব, আবার এলে সিরিয়াল পাব কি না, তা বুঝতে পারছি না।’

সূর্য বানুর চোখের ছানি অপারেশন হয়েছিল গত বুধবার। পরদিন তিনি চোখে ব্যান্ডেজ নিয়েই হাসপাতাল ছেড়ে যান। একটি ওষুধের দোকান থেকে ব্যান্ডেজ খুলে নেন। গতকাল এলেও ফলোআপ চিকিৎসা পাননি।

মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফরসহ মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করেন। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫
মঙ্গলবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফরসহ মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করেন। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

মেরি এসেছিলেন পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া থেকে। গতকাল ছিল তাঁর চোখে অস্ত্রোপচারের দিন। হতাশ এই নারী বলেন, ‘একা একা চারবার এসে অপারেশনের তারিখ পেয়েছিলাম। এখন কী করব? আবার কবে আসব, খরচ কে দেবে?’
হাসপাতালে ঠিক কত রোগী ভর্তি আছেন, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানা যায়নি। তবে জুলাই আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের মধ্য থেকে ভর্তি আছেন ৫০–৬০ জন।

এঁদের একজন চুয়াডাঙ্গার মো. আল সিরাজ। গত বছর ১৯ জুলাই রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় তাঁর দুই চোখে পুলিশের ছররা গুলি লাগে। তিনি প্রথমে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছেন, চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরেও গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালটি চালু করার জন্য সব পক্ষের বোধোদয় হওয়া উচিত। সবাই আন্তরিক হলে হাসপাতাল বন্ধ থাকার কথা নয়।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছর জুলাই–আগস্টে চোখে আঘাত নিয়ে প্রায় এক হাজার ব্যক্তি এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৮৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এঁদের মধ্যে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিয়েছেন বেশ কয়েকজন।

লন্ডনের মুরফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এসে ২৩ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করেছেন। এ ছাড়া ৭ জনকে তুরস্কে পাঠানোর ব্যবস্থা প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে।

গতকাল বেলা পৌনে একটার দিকে হাসপাতালের তিনতলায় জুলাই অভ্যুত্থানের আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল ও জুলাই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সভা হয়। সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, সভায় আহত ব্যক্তিরা তাঁদের অভিযোগ তুলে ধরার পাশাপাশি হাসপাতাল খুলে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

সেবা বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫
সেবা বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। ঢাকা, ৩ জুন ২০২৫ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

তাঁরা চারজনের নামের তালিকা দিয়ে বলেছেন, এই চারজন ছাড়া অন্য চিকিৎসক, নার্স বা কর্মকর্তারা হাসপাতালে এলে তাঁদের কোনো আপত্তি থাকবে না। আহত ব্যক্তিরা বলেছেন, তাঁদের জোর করে বাড়ি পাঠানো ঠিক হবে না। তাঁদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সরকারকে আরও মনোযোগী হতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও অন্য কর্মকর্তারা আহত ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেছেন, চক্ষুবিশেষজ্ঞদের একটি দল আহত ব্যক্তিদের চোখ পরীক্ষা করে ঠিক করবেন কাদের হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার দরকার আছে, কাদের থাকার দরকার নেই। আহত ব্যক্তিদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালেও চিকিৎসা করানোর কথা ভাবা হচ্ছে।

নিরাপত্তাহীনতা

ওপরে যখন সভা চলছিল, তখন নিচতলায় হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক ও কর্মচারী জড়ো হয়েছিলেন। সংঘর্ষের দিন তাঁরা কে, কীভাবে আহত হয়েছিলেন তার বর্ণনা দেন। একজন কর্মচারী বলেন, ১০ মাস নিজের ভাইয়ের মতো তিনি আহত ব্যক্তিদের সেবা দিয়েছেন। অথচ সংঘর্ষের দিন তাঁদের হাতেই মার খেয়েছেন।

কর্মচারীরা বলেন, আহত ব্যক্তিদের অন্য হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ, চিকিৎসক–কর্মচারী সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। একজন বাবুর্চি বলেছেন, আহত ব্যক্তিরা তাঁদের হাতের তৈরি খাবারে সন্দেহ প্রকাশ করেন। একজন চিকিৎসক বললেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তিনি তাঁদের চিকিৎসা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না।

এ পরিস্থিতির মধ্যে আজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগ খোলা হচ্ছে। তবে কোনো রোগী ভর্তি করা হবে না বা কোনো অস্ত্রোপচারও হবে না। চোখের রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রতিষ্ঠানটি ঈদের ছুটির আগে পুরোপুরি চালু হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মন্তব্য করেছেন।