Image description

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স প্রায় দশ মাস। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বলা হচ্ছে তিনটি মৌলিক কাজের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এগুলো হলো- জুলাই গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং নির্বাচন। কিন্তু এর কোনোটিরই তেমন অগ্রগতি নেই। সরকারের নীতিনির্ধারক এবং তাদের অনুসারীরা বার বার সংস্কারের বুলি আওড়ালেও বাস্তবে এর সামান্যতমও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাজকর্ম জনপ্রত্যাশার উল্টোপথে চলছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সরকারের সর্বত্র এখনো ফ্যাসিবাদী সরকারি কর্মকর্তারা বহাল-তবিয়তে আছে, নতুন করে আরও ফ্যাসিবাদী কর্মকর্তাদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ সচেতন মানুষ হতাশ। 

জুলাই গণহত্যার বিচারের কার্যক্রম ধীরে হলেও কিছুটা এগুচ্ছে, তবে নির্বাচন নিয়ে অনেকটাই বিপরীত অবস্থানে সরকার। নির্বাচনের সময় সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে একেক সময় একেক কথা বলা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতিপূর্বে কাতার সফরকালে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, জনগণ নির্বাচন চায় না। সর্বশেষ জাপান সফরকালে নিক্কেই ফোরাম ‘ফিউচার অব এশিয়া’র উদ্বোধনী অধিবেশনের বক্তব্যে বলেছেন, মাত্র একটি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। এ বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে, ১২ দলীয় জোট, এলডিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে জোরালো আওয়াজ দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে রাজি নন। তিনি ইতিপূর্বে যদিও একাধিকবার বলেছেন, সংস্কার সংক্ষিপ্ত হলে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে। এখন তা আর বলছেন না। বলছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে কখন নির্বাচন হবে সেটা বলতে নারাজ। এদিকে তলে তলে মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্র্মিকে ‘মানবিক করিডোর’ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সরকার। অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের কাছে ইজারা দেয়ার কাজটাও প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল। এর মধ্যেই তিন বাহিনী প্রধান সাক্ষাত করেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমসমুহে এই মর্মে জানানো হয় যে, তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতেই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, মানবিক করিডোর এবং বন্দর দেয়া যাবে না। নির্বাচন করে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। গণমাধ্যমসমুহে বিস্তারিত ও খোলাখুলিভাবে এমন খবর প্রচারিত হওয়ার পর সরকারের ভিত মারাত্মকভাবে নড়ে উঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাৎক্ষণিকভাবে পদত্যাগের হুমকি দেন। এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে ব্যাপক তোলপাড় চলতে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু সরকার এবং বিরোধী পক্ষ প্রত্যেকেই যার যার অবস্থানে অনড় থাকায় এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান আসেনি। আগামী দিনে কী ঘটবে- এ নিয়েও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। 

তার মধ্যেই সর্বশেষ প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কথা বলেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নিবাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনেকটা আলটিমেটাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। গত ২৮ মে রাজধানীতে বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশ থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, নির্বাচন নিয়ে ‘টালবাহানা’ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হতে হবে, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি নেতাকর্মীদের প্রতি নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

এমন প্রেক্ষাপটে নতুন করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। কারণ, এর আগে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, কোনো রকমের চাপ দেয়া হলে তারা জনগণের কাছে পরিস্থিতি তুলে ধরে পদত্যাগের ঘোষণা দিবেন। এটা অনেকটা ব্ল্যাকমেইলের মতো। বিএনপি নেতারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপিকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছেন। আকারে-ইঙ্গিতে এটা বোঝাতে চাইছেন যে, তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিলে বিএনপি পাবে না, ক্ষমতা অন্যদিকে চলে যাবে। সামরিক শাসন জারি হবে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে বিএনপি নেতারা একান্ত আলাপে বলছেন, নির্বাচন না দিয়ে ড. ইউনূসের এভাবে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাতে তিনি নিজেও ফেঁসে যাবেন।   

গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বদলে যায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের গুম-খুন-দুর্নীতিসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল দেশে। জনগণের দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। এ আন্দোলন যেন নতুন করে চিন্তার সুযোগ করে দেয় সবাইকে।  

গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনুস রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে দেন। এসব কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। এগুলো হলো- সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক, জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। 

৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সংস্কারের কার্যক্রম এগুচ্ছে না মোটেই। যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত হয়েছে সেগুলোও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই সরকারের তরফ থেকে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি-পদায়নের মাধ্যমে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় দশ মাস পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যমান কোনো সংস্কার দেখাতে পারেনি। বরং দেশের মধ্যে বেড়েছে বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা। ফলে বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবিকে যৌক্তিক বলছেন তারা। আবার জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের বিরোধী। কারণ নির্বাচন হলে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না তারা। বরং এখন সরকারের মধ্যে থেকে সরকারি দলের সুবিধা ভোগ করতে পারছেন। নির্বাচন হলে তা হাতছাড়া হয়ে যাবে পুরোপুরিই। 

এনসিপি ও ইসলামপন্থি বাদে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য বিএনপির এই অবস্থানকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে। ‘ডিসেম্বরে মাত্র একটি দল নির্বাচন চায়’ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে ১২ দলীয় জোটের নেতারা বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বরে কেবল একটি দল নয়, দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন চায়। নির্বাচনই এই দেশের মুক্তি ও উন্নতির অভিমুখ নিশ্চিত করে। বারবার তা প্রমাণিত হয়েছে।

৩০ মে শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ১২ দলীয় জোটের নেতারা এ কথা বলেন। জোটের নেতারা বলেন,  কেবল একটি দলই নয়, দেশের সব গণতন্ত্রপন্থি দলগুলো স্পষ্টভাবে গত নয় মাস ধরে ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে এসেছে। বরং তিনি নিজেই কিছু মৌলবাদী, জনসমর্থনহীন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক দলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনের প্রশ্নটিকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছেন।

গণফোরাম বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফরে গিয়ে একটি দল ছাড়া আর কোনো দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সঠিক নয়। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে বলেও উল্লেখ করেছে দলটি।

৩০ মে বিকেলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গণফোরামের সভাপতি পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরে গণফোরামের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে এবং এর ফলে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরির প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

‘বাংলাদেশের সব দল নয়, মাত্র একটি রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন চায়’- প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ। তিনি বলেছেন, তার (ড. ইউনূস) বক্তব্য সঠিক নয়। দেশের একটি দল নয়, কমপক্ষে ২০টি নিবন্ধিত দলসহ প্রায় সব দলই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। এক বিবৃতিতে তিনি  এসব কথা বলেন।

অনেকটা একই মত বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের। তিনি বলছেন, ডিসেম্বরতো বটেই তার আগেও নির্বাচন করা সম্ভব। তার মতে, এই সরকার নির্বাচন জুনে করার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারছে না। ফলে তা অপ্রয়োজনীয় কালক্ষেপণের ধারণা তৈরি করছে। নির্বাচন শুধু বিএনপির দাবি না বরং জনগণের দাবি। ১৬ বছর ধরে মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচন করার জন্য অপেক্ষা করছে।  একইসাথে দেশের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, নির্বাচনের সূচি ঘোষণার পর তাতেও লাগাম আসবে বলে মন্তব্য করেন এই রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, “নির্বাচনের শিডিউল ডিক্লেয়ার হলে, নির্বাচনের কাজে গতি আসবে। নির্বাচনমুখী তৎপরতায় সবাই যুক্ত হবে। এবং দেশের বিদ্যমান যে অস্থিরতা, আধা নৈরাজ্যিক যে অবস্থাটা চলছে তারও খানিকটা অবসান হবে।”  

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চায় নাগরিক ঐক্যও। তবে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে এখনই কোনো জোরালো সিদ্ধান্তে যেতে চাইছে না দলটি। দলটির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “ডিসেম্বর আর জুনের জেদাজেদির মধ্যে যেতে চাই না। আমরা মনে করি ডিসেম্বরে ভোট করা যায়, সরকার চাইলে (নির্বাচন) করতে পারে আর সেটা যুক্তিসংগতও হবে। কিন্তু এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ঝুঁকির কথা ভেবে আমরা হয়তো পরে সিদ্ধান্ত নেবো।” 

সবমিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একদিকে নিয়মিত প্রশাসনিক কাজগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর দাবি-দাওয়ার দিকে নজর দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার চাপও ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠান না হলে এই প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। দেশের বিগত নির্বাচনগুলো সাধারণত জানুয়ারির দিকে শুকনো আবহাওয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এরপর বছরের মধ্যবর্তী সময় বর্ষা মৌসুম হওয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযোগী নয়। সব মিলিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানের ওপর নির্ভর করছে কী হতে যাচ্ছে আগামী দিনের রাজনীতিতে। উভয় পক্ষই যদি নিজেদের অবস্থানে অনঢ় থাকে সেক্ষেত্রে দেশে আরেকটি বড় ধরনের অঘটন দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।