
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক মাস ধরে তৎপর রয়েছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রুপ-উপগ্রুপ। দখল, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি, ভাড়ায় খাটা, আধিপত্যের লড়াইসহ নানা অপকর্মে তারা হাত পাকাচ্ছিলেন। গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়া থেকে দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা পুরনো ডেরা পাল্টে উঠছেন নতুন ডেরায়। কেউ কেউ দেশ ছাড়ারও পরিকল্পনা করছেন। আন্ডারওয়ার্ল্ড সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীরা একে একে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। বেরিয়েই তারা নিজ নিজ সন্ত্রাসী বাহিনী পুনর্গঠনের পাশাপাশি দখল, চাঁদাবাজি এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে ওঠে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী। এদের মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন এবং ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল গ্রুপের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির খবর বারবার সামনে আসে। এ সময় তাদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল এবং সানজিদুল ইসলাম ইমনকে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। কোনো সন্ত্রাসী আইনের হাত থেকে রেহাই পাবে না। তাদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে, অবশ্যই তারা গ্রেপ্তার হবে।
কোনো কোনো সূত্র দাবি করেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছেন। আর পিচ্চি হেলাল দেশেই আছেন। মালয়েশিয়া থেকেই রাজধানীর ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, এলিফেন্ট রোড ও হাজারীবাগ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন। আর মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকায় নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী চালাচ্ছেন পিচ্চি হেলাল। ইতোমধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনিতে জড়িতের অভিযোগে ইমন, পিচ্চি হেলাল এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও জিডি হয়েছে। ইমন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড জাহিদ হোসেন ওরফে চাচা জাহিদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় তৎপর রয়েছেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর এই জাহিদ হোসেন নিউমার্কেট এলাকার একটি মার্কেট কমিটির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। আর গত বছর ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ইমন ও পিচ্চি হেলাল বাহিনীর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলে আসছে। তবে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী এই দুই বাহিনীর সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত দুই মাসে রাজধানীতে তিনটি খুন, দখল, চাঁদাবাজি এবং হামলার ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ ও বিকাশের নাম আসে। গত রবিবার রাতে বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় বিএনপির নেতা কামরুল আহসানকে (সাধন) গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকা-ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নাম সামনে আসে। এর আগে ১৯ এপ্রিল হাতিরঝিলে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ শিকদারকে গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকা-ের পেছনেও সুব্রত বাইনের সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনার কিছুদিন আগে ১৩ মার্চ মগবাজারের ওয়্যারলেস রেলগেটের পাশে একটি ক্লাব ঘরের ভেতরে কুপিয়ে ও মাথা থেঁতলে দেওয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য মো. রাজনকে। পরে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে ফেরেন তিনি। এ ঘটনায়ও সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ।
যুবদলের সদস্য আরিফ সিকদার ছিলেন দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ। মগবাজার, রামপুরাসহ আশপাশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জিসানের সঙ্গে সুব্রত বাইনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয় অতি সম্প্রতি। আরিফ শিকদার জিসানের পক্ষ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলেন। এ বিষয়টি জানার পরই সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের নির্দেশে আরিফকে হত্যা করা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ ৪ সন্ত্রাসী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তাদের অন্য সহযোগীরা পুরনো আস্তানা বদলে ফেলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তাদের লক্ষ্য গ্রেপ্তার এড়ানো। ইতোমধ্যে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের পলাতক সহযোগীদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক টিম। তৎপর রয়েছে সেনাবাহিনীও।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেছেন, শুধু সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের সহযোগীদের নয়, ঢাকায় তৎপর সব শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে আমাদের দুই ধরনের পুলিশিং ব্যবস্থা চলমান আছে। আমরা গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছি। এ ব্যাপারে নানামুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জানা যায়, গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু ও আরমান কারাগার থেকে মুক্তি পান। আর মোল্লা মাসুদ ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরেন আমিন রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর।