Image description

ভারতীয় নাগরিক হয়েও ছিলেন দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে। এ সুবাদে দুই হাতে কামিয়েছেন অবৈধ অর্থ। তবে সেসব টাকা দেশে না রেখে অবৈধ পথে ভারতে পাঠিয়েছেন।

সেখানেই গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তিনি হলেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) ও উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) রনঞ্জয় কুমার দত্ত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতের কলকাতার দক্ষিণ চব্বিশপরগনা জেলার সরশুনা থানার ১৩৩ মেইন রোড এলাকার বাসিন্দা রনঞ্জয়। কেবল ভারতীয় নাগরিকত্বই নয়; বরং সেখানকার ভোটারও তিনি। গত ৩০ বছর ভারতের জাতীয় ও স্থানীয় পঞ্চায়েতসহ প্রতিটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। ভারতে তার জাতীয় পরিচয়পত্র বা আধার কার্ড এবং প্যান কার্ড (স্থায়ী অ্যাকাউন্ট নম্বর) রয়েছে।

সূত্র জানায়, রনঞ্জয় পিরোজপুর সদর উপজেলার কুমারখালী গ্রামের বাসিন্দা পরিচয়ে তিতাস গ্যাসের ডিজিএম (অ্যাডমিন) ও ভারপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করেছেন। ২০২২ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। এর আগে চাকরির সুবাদে বৈধ ও অবৈধভাবে অর্জিত শত কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন ভারতে। আর ওই টাকায় ভারতে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।

সূত্র বলছে, ছয়তলা বিলাসবহুল একাধিক বাড়ির পাশাপাশি তিনটি ফ্ল্যাট, একাধিক গাড়ি, একাধিক ডিপিএস পলিসি এবং কয়েক একর সম্পত্তিসহ ভারতে বহু সম্পদ তার। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ভারত-বাংলাদেশের উভয় এলাকায়ই ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত রনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন পিরোজপুর জেলার একাধিক বাসিন্দা। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন শুরু হলেও উপজেলা প্রশাসন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত কিংবা কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাইলে অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেন পিরোজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সজল মোল্লা। তিনি জানান, এ বিষয়ে তার কিছুই করার নেই।

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গ্রামে রনঞ্জয় দত্তের বাবার পাঁচ থেকে ছয় বিঘা ফসলি জমি আছে। তিতাস গ্যাসে চাকরির পর তিনি পিরোজপুর সদরে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি কেনেন। এখানে তার একটি চালের আড়ত ও তিনটি দোকানঘর রয়েছে, যা অন্যের কাছে ভাড়া দেওয়া। তবে তিতাস গ্যাসে চাকরির পরপরই তিনি অবৈধভাবে অর্জিত কোটি কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাচার শুরু করেন।

৩০ বছর আগে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে কলকাতার দক্ষিণ চব্বিশপরগনার সরশুনা থানার ১৩৩ মেইন রোড এলাকায় জমি কেনেন রনঞ্জয়। পরে স্ত্রী ছায়া দত্ত ও দুই ছেলে অরিত্র দত্ত ও অর্নব দত্তকে ভারতে পাঠিয়ে দেন। সেখানেই ছয়তলা বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করছেন তারা। একই এলাকায় কয়েক কোটি টাকা মূল্যের তিনটি ফ্ল্যাটও কিনেছেন রনঞ্জয়। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে কিনেছেন কয়েক একর সম্পত্তি। এর মধ্যে বেশকিছু জমি ডেভেলপারকে দিয়েছেন বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য। ২০২২ সালে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তিও করেন। বর্তমানে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।

শুধু জমি ও বাড়িই নয়; বরং ভারতে কোটি টাকা মূল্যের বেশ কয়েকটি গাড়িও কিনেছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র আরো জানায়, রনঞ্জয়ের দুই ছেলে ভারতে পড়াশোনা শেষ করেছে। চাকরিকালীন স্ত্রী ও ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটাতে তিনি ছুটি নিয়ে প্রায়ই ভারতে যাতায়াত করতেন। এ সময় তিনি পাচার করতেন কোটি কোটি টাকা।

অভিযোগকারী অরুন হালদার বলেন, একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে কী করে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন, তা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, কোনোভাবেই যেন রনঞ্জয় পেনশনের টাকা নিয়ে দেশ থেকে পালাতে না পারেনÑএ বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।

কাউখালী সদর উপজেলার বাসিন্দা সুজিৎ সাহা বলেন, ‘চাকরিরত অবস্থায় রনঞ্জয় কমপক্ষে ৩০ বছর আগে ভারতের নাগরিক হন এবং বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করে ভারতে সম্পদের পাহাড় গড়েন। এ ছাড়া ভারতীয় নাগরিক রনঞ্জয় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর কাউখালী কেন্দ্রীয় শ্রীগুরু সংঘের সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করে রাখেন। বর্তমানেও তিনি সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন। একই ভাবে অপর ভারতীয় নাগরিক রতন করকে করেছেন ওই কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক।

সূত্র জানায়, শ্রীগুরু সংঘের সারা দেশে ১০৮টি শাখা ও আশ্রমসহ সারা দেশের ভক্তরা এখানে অনুদান ও প্রণামির টাকা দেন। প্রতি বছরই এই শ্রীগুরু সংঘে কয়েক কোটি টাকা জমা হয়। গত ১০ বছর ধরে তিনি স্থানীয় লোকদের হাত করে সংঘের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে তা ভারতে পাচার করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ওই সংঘের অন্য সদস্যদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। তবে তার প্রভাবে কেউই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। এমনকি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তিনি অন্য সদস্যদের ভয়ভীতি দেখান বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে রনঞ্জয় কুমার দত্তের কাছে বক্তব্য নেওয়ার জন্য শ্রীগুরু সংঘের আশ্রমে গেলে তিনি এ প্রতিবেদকের ধর্মীয় পরিচয় জেনে নিজ সম্প্রদায়ের লোক হিসেবে কাকুতি-মিনতি করেন। তিনি বলেন, ‘সবই তো বুঝতে পেরেছেন, আমাকে বাঁচান।’

জানতে চাইলে কাউখালী থানার ওসি সোলায়মান জানান, তার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে অভিযোগকারীদের নাম বলার পর তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এমনকি আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিও এড়িয়ে যান। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে অভিযোগ পাঠিয়েছেন কি নাÑজানতে চাইলে এ বিষয়টিও এড়িয়ে যান।

কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সজল মোল্লা আমার দেশকে বলেন, ‘১০ ব্যক্তি এসে রনঞ্জয় কুমার দত্ত নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয় নাগরিকত্বের অভিযোগ আনেন। এমনকি কিছু প্রমাণও তারা দিয়েছেন। বিষয়টি থানার ওসিকে জানানো হয়েছে।’