Image description

কর্মরত কূটনীতিক হয়েও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম। জেনারেশন নেক্সট নামের ওই কোম্পানির পরিচালক ছিলেন তিনি। আর মুনার স্বামী তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন কোম্পানিটির চেয়ারম্যান। জুলাই বিপ্লবের পর এ কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ সব পরিচালক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি চাকরি থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে থাকা আইনত দণ্ডনীয়। এত বড় ঘটনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় না জানার কথা নয়।

কোম্পানির নথি ঘেঁটে জানা যায়, জেনারেশন নেক্সটের ৫০ হাজার শেয়ারের মধ্যে মুনার স্বামী তৌহিদুল ইসলাম ৪৫ হাজার শেয়ার নিয়ে চেয়ারম্যান হন ২০০৪ সালে। একই সময়ে ২ হাজার ৫০০ শেয়ার নিয়ে পরিচালক হন সাঈদা তাসনীম মুনা। তখন এ সরকারি কর্মকর্তার বয়স ছিল ৩৮ বছর। প্রতিষ্ঠানটির অন্য পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন শাহীন আখতার চৌধুরী, রাজিব শেঠি ও ওয়াহিদ সালাম।

তাসনিম ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে কাজ শুরু করেন। ২০০৪ সালে তাসনিম মুনার স্বামী নিউইয়র্কের একটি ক্লাবে অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই বছরের জুনে তাসনিমকে বাংলাদেশের জাতিসংঘ মিশনে তার পোস্টিং থেকে প্রত্যাহার করে। তবে ২০১৪ সালে মুনাকে আবার থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৮ সাল থেকে তিনি যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০২৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ওই দায়িত্বে ছিলেন।

গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পরই বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনে থাকা রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়োগ বাতিল এবং রদবদলের উদ্যোগ নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর প্রায় ছয় বছর যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করা সাইদা মুনা তাসনীমকে অনতিবিলম্বে ঢাকায় ফেরার নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়।

 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ নাজমুল হক স্বাক্ষরিত এক দাফতরিক আদেশে তাকে লন্ডনের দায়িত্বভার ত্যাগ করে অনতিবিলম্বে ঢাকায় ফিরতে বলা হয়।

বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা সাইদা মুনা তাসনীমের গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। রেওয়াজ অনুযায়ী সাধারণ একজন কূটনীতিক কোনো মিশনে তিন বছর রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে লন্ডনে হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

মুনার বিরুদ্ধে অন্ধ আওয়ামীপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ও এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।

এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুনাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়ার পর তিনি অসুস্থতাজনিত ছুটির আবেদন করেন। কিন্তু সেই ছুটি অতিবাহিত হওয়ার পরও তিনি দেশে ফেরননি। এমনকি, তিনি তার অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেননি।

এদিকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মুনা ও তার স্বামী তৌহিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে ১২টি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আনুমানিক ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

দুদকে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন সম্প্রতি বলেছিলেন, সাবেক হাইকমিশনার ও তার স্বামী তৌহিদ জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেডসহ ১২টি নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ইউসিবিএল, ব্যাংক এশিয়া, ইবিএল, সিটি, ব্র্যাক, এনবিএল, ট্রাস্ট, সাউথইস্ট, এবি ব্যাংক) থেকে ঋণ নিয়ে আনুমানিক ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

মুনার বিরুদ্ধে থাইল্যান্ডে দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। কিন্তু, আওয়ামীলীগের হেভিওয়েট নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ঢাকা পড়ে যায়।

সরকারি চাকরিতে থেকেও একটি কোম্পানির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রসঙ্গে জন প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আমার দেশকে বলেন, এটি সরকারি চাকরিবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সরকারি চাকরির বিধানে বলা আছে, সরকারি কর্মচারী কোনো কোম্পানির মালিক পরিচালক বা অন্যকিছু হতে পারবেন না। আর কোনো ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন না। কারণ সে ২৪ ঘণ্টা সরকারি কর্মচারী। ব্যবসা করতে গেলে সে তো ওই সবই দেখবে, সরকারি কাজে মন দেবে না।

মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, এ ঘটনাটি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট (স্বার্থের সংঘাত)। এটি অসদাচরণের আওতায় পড়ে। মিসকন্ডাকটের কারণে তিরস্কারের পাশাপাশি চাকরি থেকে বরখাস্তসহ যেকোনো দণ্ড দিতে পারে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন ঘটনা জানার কথা, তাদের নজরের বাইরে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল।

জানা গেছে, গত অক্টোবরে সরকার সব শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে জেনারেশন নেক্সট নামের ওই কোম্পানিটি বন্ধও করে দেওয়া হয়। কিন্তু আবার নতুন করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করতে বিদেশে পলাতক মালিকদের অনুরোধে কারখানাটি বিক্রির চিন্তা করছে শ্রম মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর জেনারেশন নেক্সটের সব মালিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ছিল চার হাজারের বেশি। পরে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে সব শ্রমিকের বেতন বুঝিয়ে দিয়ে লে-অফ (বন্ধ) ঘোষণা করে সরকার। বাংলাদেশ সরকার, পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও কারখানার ত্রিপক্ষীয় সমঝোতায় কোম্পানিটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

অক্টোবরে সব বেতন-ভাতা পরিশোধের পরও গত ২৮ মে নতুন করে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সব সম্পদ বিক্রির জন্য পররাষ্ট্র সচিবের কাছে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়। শ্রম মন্ত্রণালয়ের শ্রম শাখার উপসচিব মোহাম্মদ শামসুল ইসলামের স্বাক্ষরিত চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

জেনারেশন নেক্সটের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ মে শ্রম মন্ত্রণালয় এ চিঠি পররাষ্ট্র সচিবের কাছে পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়, ‘জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেডের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যক্তিগত স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শ্রমিক ও কর্মচারীদের সব বকেয়া পাওনা এককালীন পরিশোধের জন্য বিদেশে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট দূতাবাস (যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ও কানাডা) কর্তৃক পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ইস্যুর লক্ষ্যে সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশক্রমে স্ব-ব্যাখ্যাত আবেদনপত্র অগ্রায়ন করা হলো।’

চিঠির বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয় মোহাম্মদ শামসুল ইসলামের সঙ্গে। তবে তিনি তাতে সাড়া দেননি।

বিজিএমইএর সাবেক একজন পরিচালক আমার দেশকে বলেন, ‘ওই কোম্পানির লে-অফ হয়েছে বেতন পরিশোধের পর। তবে এখনো বেতনের যে বেনিফিট তা বাকি আছে। সর্বসাকুল্যে তা ২০ কোটি টাকার মতো হতে পারে। শ্রম মন্ত্রণালয় এখন কেন তা বিক্রি করছে তা অস্পষ্ট।

বিজিএমইএর সাবেক ওই পরিচালক আরও বলেন, এ কোম্পানির যেসব যন্ত্রপাতি আছে তার বেশির ভাগই অত্যাধুনিক। এটি বন্ধ রাখার চেয়ে নতুন করে চালু করতে পারলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। শোনা যাচ্ছে, কোম্পানিটির সাবেক পরিচালকদের কেউ কেউ সেটিকে নতুন করে চালু করতে চাচ্ছেন।