Image description
ইসিএ থেকেই দেদার তুলছে পাথর-বালু

সিলেটে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) থেকেই দেদার তোলা হচ্ছে পাথর-বালু। পাহাড়, টিলা কিংবা সমতল ভূমি-সবই পাথর ও বালুখেকোদের দখলে। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, লুটপাট ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না প্রশাসন। অন্যদিকে ব্যর্থতার দায় না নিয়ে নানা সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন জেলা প্রশাসক।

যুগান্তরের হাতে থাকা ইসিএ গেজেট অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পাথরকোয়ারি এলাকার ডাউকি নদীকে ইসিএ ঘোষণা করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়। নদীর দুই পাশে ৫০০ মিটারসহ ১৪.৯৩ বর্গকিলোমিটার এই ইসিএ এলাকা। গেজেটের ৮ নম্বর নির্দেশনায় এ এলাকায় যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে কোনো ধরনের খনিজসম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে গেজেট অনুযায়ী, ইসিএ এলাকা চিহ্নিত করতেই সময় লেগে যায় ৩ বছর। এ সময়ে চলছে ব্যাপক লুটপাট। সবশেষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সারা দেশের মতো স্থানীয় প্রশাসনে কিছুটা স্থবিরতা এলেই শুরু হয় লুটপাট। মাত্র ১০ দিনেই শতকোটি টাকার পাথর লুটের হিসাব দেয় উপজেলা প্রশাসন। তবে লুটপাট এখনো থামেনি।

সম্প্রতি দুইদিন সরেজমিন দেখা যায়, হাজারো নৌকা নিয়ে শ্রমিকরা ইসিএ ঘোষিত জাফলং ডাউকি নদী থেকে বালি আর ছোট পাথর তুলছে। এসব খনিজসম্পদ তীরে এনে বিক্রি হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। আবার সেখান থেকে ট্রাকে করে বালি-পাথর চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয়দের মতে, প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ট্রাক ৫০০ থেকে ৬০০ ঘনফুট বালি নিয়ে যাচ্ছে শুধু ডাউকি নদী থেকেই। তারা জানান, রাত হলে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে জাফলংয়ের পরিবেশ। সন্ধ্যার পর থেকেই বড় বড় ড্রেজার ও ভলগেট ঢুকে যায় জাফলংয়ে। রাতভর সেসব ভলগেট ভরে কয়েক লাখ ঘনফুট বালি সরিয়ে নেয়।

জাফলং থেকে নৌকায় প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার ডাউকি নদী ধরে সামনে এগিয়ে গেলে দেখা মিলে নদীর তীরে সারি সারি রাখা আছে বড় বড় স্টিলের তৈরি নৌকা (ভলগেট)। নৌকার মাঝি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানালেন, সন্ধ্যার পর এসব নৌকাই জাফলং ব্রিজ পার হয়ে ঢুকে পড়ে জাফলংয়ে। আরও কিছুদূর সামনে আগালেই দেখা মিলে বড় বড় বালির স্তূপ। সেদিন সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর পরিবেশ অধিদপ্তর মিলে যৌথ অভিযান চলছিল। সঙ্গে পুলিশ ও আনসার সদস্য। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এসব বালি বাওরবাগ হাওড় ও তীতকুল্লি হাউড় এলাকার গোয়াইন নদী থেকেই ৫ আগস্টের পর উত্তোলন করা হয়েছে।

স্থানীয় শিক্ষার্থী আজমল জানান, তারা নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন নামের একটি সংগঠন থেকে দীর্ঘদিন প্রতিবাদ করে আসছেন, তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। অভিযান শেষে গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী জানান, তাদের কাছে তথ্য আছে এসব বালি ইসিএ এলাকা থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। তাই তারা সরকারের অনুকূলে জব্দ করছেন।

শুধু গোয়াইনঘাট নয়, কোম্পানীগঞ্জের অবস্থা আরও করুণ। সরেজমিন শাহ আরেফিন টিলায় দেখা যায়, দিনেও চলছে পাথর উত্তোলন। ভয়ে কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্টের পর থেকে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি পাথর উত্তোলন। তাদের মাতে, শতকোটি টাকার পাথর ইতোমধ্যেই লুট হয়েছে শাহ আরেফিন টিলা থেকে।

একই উপজেলার পর্যটন এলাকা ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে বাঙ্কার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপ। বড় বড় গর্ত। পাথর তুলতে কেটে ফেলা হয়েছে গাছপালা। আগে রাতের আঁধারে লুট হলেও এখন দিনেই চলছে বলে জানালেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, এখান থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার পাথর ইতোমধ্যে লুট হয়েছে।

এমন লুটপাটকে স্মরণকালের ভয়াবহ বলছেন পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা বেগম। তিনি বলেন, বর্তমানে যা হচ্ছে, এর দায় কোনোভাবেই প্রশাসন এড়াতে পারবে না। কার্যত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না। তিনি প্রশাসনকে ব্যর্থ বলতে নারাজ। তার মতে, লুটপাট বন্ধ করতে চেষ্টা করে না পারলে ব্যর্থ বলা যেত; কিন্তু তেমন কোনো ব্যবস্থাই যখন কেউ না নেয়, তখন তাদের ব্যর্থ না বলে উদাসীন বলাই ভালো।

জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনের কোনো ব্যর্থতা নয়, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনার কথা বলে তিনি জানান, অভিযান শেষেই আবারও শুরু হয় বালি-পাথর উত্তোলন। এসব দেখভাল ও লুটপাট বন্ধ করতে যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, এর ঘাটতি রয়েছে। তবে শিগ্গিরই সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এসব খনিজসম্পদ লুটপাট বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।