
আইনবহির্ভূতভাবে পুশইন অব্যাহত রেখেছে ভারত। সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এমন ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়, জানিয়ে বাংলাদেশ চিঠি দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না দেশটি। এছাড়া বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে দফায় দফায় পতাকা বৈঠক হলেও চোরাপথে বা বিজিবির অগোচরে পুশইনের ঘটনা বাড়ছেই, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পুশইনের এসব ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। যাদের পুশইন করা করা হচ্ছে তারা কারা, কোন দেশের নাগরিক-এসবের কিছুই জানা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে দেশটি নিজেদের আইন ও সংবিধানও লঙ্ঘন করছে। তারা বলেন, এটা বাংলাদেশকে চাপে রাখার একটা কৌশল। ভারত এই ধরনের কাজ অতীতেও করেছে। এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আরও জোরালো আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে পারে বলেও মনে করেন তারা। পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত অবৈধ ভারতীয় নাগরিকদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ৭ মে থেকে এ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১১১, কুড়িগ্রামে ৮৪, সিলেটে ১০৩, মৌলভীবাজারে ৩৩১, হবিগঞ্জে ১৯, সুনামগঞ্জে ১৬, দিনাজপুরে ২, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৭, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯, পঞ্চগড়ে ৩২, লালমনিরহাটে ৭৫, চুয়াডাঙ্গায় ১৯, ঝিনাইদহে ৪২, কুমিল্লায় ১৩, ফেনীতে ৩৯, সাতক্ষীরায় ২৩ এবং মেহেরপুরে ৩০-সহ ৯৭৫ জনকে পুশইন করেছে ভারত। এছাড়া সুন্দরবনের গহিন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ৭৮ জনকে পুশইন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনীরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে ভারত থেকে বেশকিছু মানুষকে পুশইন করা হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য পন্থা নয়। ভারত যদি মনে করে তাদের দেশে অবৈধভাবে কোনো বাংলাদেশি বসবাস করছে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আইনসম্মত যে প্রক্রিয়া আছে, তা অনুসরণ করে দুই দেশের সম্মতিতে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। আমাদের সম্মতি না নিয়ে যে কাউকে পুশইন করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের সঙ্গে জোরালো ভাষায় আলোচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, সীমান্তে যেসব পয়েন্ট থেকে পুশইন হচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি পুশইন বন্ধ করতে হবে। এছাড়া পুশইনের ক্ষেত্রে বেশকিছু ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা জানি না যাদের পুশইন করা হচ্ছে তারা কারা। এদের মধ্যে এমন কেউ থাকতে পারে যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি হিসাবে সামনে চলে আসতে পারে। ফলে এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের হুমকি হিসাবে আসছে। কাজেই সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। সর্বোপরি ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এটা বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।
জানতে চাইলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক আবু রূশ্দ যুগান্তরকে বলেন, একটা প্রেশার ট্যাকটিস তারা ফলো করছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী বাঙালি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এখন কাকে ধরে নিয়ে এসে কী নাম দিয়ে পুশইন করছে, এটা তো আমরা জানি না। তারা এ ধরনের চেষ্টা আগেও করেছে। এখন যে কারণে করছে সেটা হলো, আমরা যেন চীনের সঙ্গে সামরিক কোনো কিছুতে যেতে না পারি বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো কিছুতে যেতে না পারি। এজন্যই তারা এটা করছে। আর কিছু নয়।
ভারত কোনো কিছুতেই লিগ্যাল কোনো পথ অনুসরণ করে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যখন তাদের (ভারতের) বন্ধুপ্রতিম কোনো সরকার থাকে, ভারতকে নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়, ট্রান্সশিপমেন্ট দেয়, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দেয়, তখন তারা কিছু করে না। এটুকু বদান্যতা দেখায়। যখনই এ সুবিধাগুলো পায় না, তখনই তারা এসব শুরু করে। এটা অতীতেও করেছে, এখনো করছে।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় প্রসঙ্গে আবু রূশ্দ মনে করেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইস্যুটাকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু আমরা তো সেটা করছি না। ১৯৯৩, ৯৪, ৯৫ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকতে এটা নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতিসংঘে সারাজাগানো ভাষণ দিয়েছিলেন। জাতিসংঘে কেস টেকআপ করা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনগুলোয় জানানো হয়েছিল। এখনো আমরা এগুলো করতে পারি। এছাড়া চীনকে জানাতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রকে জানাতে পারি। এগুলো সামাল দিতে গেলে বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে স্ট্যাটেজিক অ্যালায়েন্স করা উচিত বলেও মনে করেন বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক।
এদিকে সীমান্তে পুশইন ইস্যুতে ভারতের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশিদের প্রোপার চ্যানেলের মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। মঙ্গলবার রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্প্রতি সীমান্তে পুশইনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, এজন্য আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। বাংলাদেশিদের প্রোপার চ্যানেলের মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছি। আমরা উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরেছি। যথাযথ চ্যানেল ব্যবহার করলে আমরা আমাদের নাগরিক হিসাবে তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সীমান্তে কোনো সুরক্ষা ঘাটতি নেই। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের বাহিনী সম্পূর্ণ সক্ষম ও প্রস্তুত।
এর আগে ৮ মে এমন ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভারতে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে অবিলম্বে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে এ ধরনের পুশইন গ্রহণযোগ্য নয়।’ এদিকে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইন করায় বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। এছাড়া পুশইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
ভারতের প্রচলিত আইন হলো-বিদেশ থেকে কেউ যদি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া দেশটিতে প্রবেশ করে, তবে তাকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। দেশটির বিদেশি আইনের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী মামলা হবে। মামলায় যদি সেই ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে তার সাজা হবে। সাজা শেষে আদালতের মাধ্যমেই তাকে নিজ দেশে (যে দেশ থেকে গিয়েছেন, সেখানে) ফেরত পাঠানো হবে। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয়রা যে অধিকার পান, সেই একই অধিকার ভারতের মাটিতে থাকাকালীন বিদেশি নাগরিকরাও পাবেন। কিন্তু বাংলাদেশি সন্দেহে ধরপাকড় বা তাদের পুশইন নিয়ে যা হচ্ছে, সেখানে তারা নিজেদের দেশের আইন এবং সংবিধানও মানছে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।