
কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ্যে এবং প্রশাসনের নাকের ডগায় অভিভাবকরা নিজেদের কন্যাকে কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন। আগে প্রশাসনের ভয়ে অভিভাবকরা গোপনে কন্যাদের বাল্যবিয়ে দিলেও গত বছরের আগস্টের পর থেকে এটি রোধে দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কার্যকারিতার অভাবে সবার সামনেই এখন নিজ সন্তানের বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এক্ষেত্রে অনেক সময় বিভিন্ন কারণে সংসার করতে না পারলে বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েটিকে দুই-তিনবারও বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের টোল ফ্রি কল সেন্টার ‘১০৯’-এ আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে কল আসছে। এর অনেকগুলোই বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য আসছে বলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয় এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। আর এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে। চলতি বছরের মার্চে ইউনিসেফ, ইউএন উইমেন এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এর ‘গার্লস গোলস : হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জনড ফর গার্লস? অ্যাডলসেন্ট গার্লস রাইটস ওভার ৩০ ইয়ার্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে। একই বয়সি নারীদের মধ্যে ১৮ বছর হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম নিয়েছে ২৪ শতাংশ নারীর। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে মাত্র ৪৭ শতাংশ নিজেদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে জেনেবুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, প্রত্যন্ত এলাকায় ১২ বছর হলে আর শহর এলাকায় ১৪-১৬ বছর থেকেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে বাল্যবিয়ের হার বেশি। সাধারণত অভিভাবকরা দরিদ্রতা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাল্যবিয়ে দিলেও এখন সামাজিক অভ্যাসবশত কারণেও অনেকে মেয়ের কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারগুলো তাদের পরিচিত ও আশপাশের পরিবারগুলোর মেয়ের বাল্যবিয়ে দিতে দেখলে নিজের কন্যাকেও কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধানুড়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গেল চার বছরে স্কুলটির ১০৬ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের কারণে বিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছে। বিদ্যালয় সূত্র জানায়, চাপিলা ইউনিয়নের ধানুড়া, চন্দপুর, শ্যামপুর, পুঠিমারী ও ওয়াপদা বাজার এলাকার মেয়েরা এ বিদ্যালয়ে পড়ে। অধিকাংশ ছাত্রীর পরিবারই নিম্নআয়ের কৃষক এবং দিনমজুর। দরিদ্রতা, কুসংস্কার এবং শিক্ষার প্রতি উদাসীনতার সুযোগে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা।
বিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ২০৩ জন ছাত্রী। কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত টিকেছে মাত্র ১২৩ জন। বাকি ৮০ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের কারণে বিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছিল ২৫ জন ছাত্রী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি ১০ জন। তাদেরও সবার বিয়ে হয়ে গেছে বলে জানায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর ফলাফলে দেখা যায়, দেশে নারীদের ক্ষেত্রে ১৫ বছর বয়সের আগে বিয়ের হার বাড়ছে।
এতে বলা হয়, ২০২৩ সালে বয়স ১৫ হওয়ার আগেই বিবাহিত নারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশে। এটি ২০২২ সালে ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাল্যবিয়ে বেড়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৫ বছরের আগে গ্রামে ২০২৩ সালে নারীদের বাল্যবিয়ের হার ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২ সালে এটি ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০২১ সালে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। শহরে ২০২৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাল্যবিয়ের হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮, ৫ দশমিক ৩ এবং ৪ দশমিক ৬। আর ১৮ বছরের আগে গ্রামে ২০২৩ সালে নারীদের বাল্যবিয়ের হার ছিল ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২২ সালে ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১ সালে ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ। আর শহরে ২০২৩ সালে নারীদের বাল্যবিয়ের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
২০২২ সালে ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। বাল্যবিয়ে বন্ধ নিয়ে কাজ করে ‘প্রেরণা’ নারী উন্নয়ন সংগঠন। এর নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বাল্যবিয়ে নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করত তাদের কার্যক্রম কমে যাওয়ায় এখন অনেকটা প্রশাসনের সামনে প্রকাশ্যেই বাল্যবিয়ে হচ্ছে। আগে প্রশাসনের ভয়ে অভিভাবকরা কিছুটা লুকিয়ে বাল্যবিয়ে দিলেও এখন তারা অনেকটা বেপরোয়া হয়েই নিজেদের কন্যাসন্তানের বিয়ে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে সংসার করতে না পারলে বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েটির দুই-তিনবারও বিয়ে হচ্ছে।
শুধু গ্রামেই নয়, শহরের মেয়েরাও বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। এজন্য বাল্যবিয়ে রোধে গ্রামের কিশোরী ক্লাবসহ জেলার মহিলাবিষয়ক কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব, (নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ মনিটরিং অধিশাখা) ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কিশোর-কিশোরী ক্লাবের কার্যক্রম চলছে। ‘১০৯’ টোল ফ্রি কলসেন্টারে আগের তুলনায় কলের সংখ্যাও বেড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কলই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের জন্য আসছে। এরই মধ্যে এই কলসেন্টারের মাধ্যমে ১০ হাজারের বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পুলিশের সহায়তা লাগে কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় পুলিশ বাহিনী এখনো মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বল। এর কিছুটা প্রভাব বাল্যবিয়ের ওপর পড়তে পারে।