Image description

দেশের চামড়া শিল্পে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। প্রতি বছর শুধুমাত্র কোরবানি ঈদে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ পশুর চামড়ার যোগান দেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বছর ঘুরলেও চামড়া ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে না। একে একে ট্যানারি শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসা হয়ে যায় ঢাকা নির্ভর। এরপর নানা সংকটে ধুঁকছে এখানকার চামড়াখাত। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ঢাকার ট্যানারি মালিক সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। তাদের মর্জিমাফিক দরে চামড়া বিক্রি করতে হয়। আর পাওনা টাকা পেতে ঘুরতে হয় বছরের পর বছর।

জানা যায়, চট্টগ্রামে ট্যানারি না থাকায় তারা জিম্মি ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে। মৌসুমি ও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রথমে চামড়া সংগ্রহ, পরে লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকায় পাঠানোসহ সবই করেন আড়তদাররা। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিভিন্ন সময় টাকা আটকে পড়া, বহু দেনদরবার করেও সেই টাকা আদায় করতে না পারায় গত কয়েক বছরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন চট্টগ্রামের অন্তত দুইশ’ আড়তদার। প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছেন মাত্র ২৫-৩০ জন। এখন তাদের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়েছে। দেউলিয়া হয়ে পড়া এক ব্যবসায়ী হলেন- চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর মো. সামশুল আলম। বাবা আহমদ হোসেন ৪৯ বছর ধরে এ ব্যবসা করেছিলেন। ২০২০ সালে মারা যান তার বাবা। সামশুল আলম বলেন, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকার বকেয়া পাচ্ছেন না আট বছর ধরে। এছাড়া ২০২২ সালে ৩৮ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। সবমিলে ধার-দেনা ও ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে আর দাঁড়াতে পারিনি। পুঁজি হারিয়ে তার মতো অন্তত দুই শতাধিক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছেন বলে দাবি করেন তিনি। নাম প্রকাশ না করা শর্তে নগরের আতুরার ডিপো এলাকার একজন প্রসিদ্ধ কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, ‘চট্টগ্রামে মাত্র একটি ট্যানারি থাকায় আমাদের বেশির ভাগ চামড়া ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হয়। এতে তারা প্রতিবছর আমাদের কোটি কোটি টাকা আটকে রাখে।’

ওই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, গত এক দশকের ব্যবসায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে ৩০ কোটি টাকা পাবেন। তারা এই টাকা পরিশোধে সব সময় গড়িমসি করেন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার-ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, টাকা সংকটে ধুঁকছেন আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। গত বছরের বকেয়া টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। এর আগেরও প্রায় ২৫ কোটি টাকা বকেয়া পাওনার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিবছর কোরবানি এলে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর বৈঠক করে। আমরা সংকটের কথা বলে আসছি। কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। চট্টগ্রামে আরও দু’-একটি ট্যানারি থাকলে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পেতেন বলে জানান তিনি।

ট্যানারি শিল্পের স্বর্ণযুগে চট্টগ্রামে বাংলাদেশি মালিকানাধীন মন্টি ট্যানারি নামের একটি মাত্র ট্যানারি ছিল। বাকি সব ট্যানারি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। স্বাধীনতার পর কারখানাগুলো সরকারের হাতে চলে যায়। সরকারি খাতে কিছুদিন চালানোর পর দেশের ব্যবসায়ীরা এগুলো কিনে নেন। পুরনো ট্যানারিগুলোর পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন ট্যানারিও ওই সময় গড়ে ওঠে। হিলটন লেদার নামের ট্যানারি ছিল ওই সময়কার দেশের প্রথম অত্যাধুনিক ট্যানারি। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে ওরিয়েন্ট ট্যানারি, মেঘনা ট্যানারি, জামান রহমান ট্যানারি, জুবিলি ট্যানারি, সিকো লেদার, চিটাগং লেদার, কর্ণফুলী লেদার, মদিনা ট্যানারি, মেট্রোপলিটন লেদার, রিফ লেদারসহ ২২টি ট্যানারি গড়ে ওঠে। বেশ জমজমাট ব্যবসা চলে ট্যানারি শিল্পের। চট্টগ্রাম থেকে কোটি কোটি টাকার চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু একপর্যায়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। একে একে বন্ধ হতে থাকে ট্যানারি। শুরুতে মেট্রোপলিটন লেদার চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় চলে যায়। বাকিগুলোর মধ্যে শুধু রিফ লেদার চট্টগ্রামে থাকলেও বাকিগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে।