Image description
অতিরিক্ত বই ছাপানো বন্ধ

নতুন শিক্ষাবর্ষ সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার কার্যক্রমে জোরেশোরে প্রস্তুতি শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। চলতি বছর মাঠ থেকে আসা চাহিদা পাঠানোতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে গত বছরের তুলনায় ৪ কোটি বই এবং ২১ লাখ শিক্ষার্থীর চাহিদা কম এসেছে। এই অতিরিক্ত বই ছাপাতে গত বছর ২০০ কোটি টাকা গচ্চা গেলেও চলতি বছর অতিরিক্ত বই ছাপানো বন্ধ হওয়ায় একই পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। আগামী বছর বইয়ের মান নিশ্চিত করতে কঠোর অবস্থানে সংস্থাটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি বছর কত সংখ্যক বই ছাপানো হবে, তা ঠিক হয় উপজেলা, থানা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছ থেকে আসা বইয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ ছিল মাঠ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি বইয়ের চাহিদা আসে। তাই প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি অতিরিক্ত বই ছাপাতে হয়। এতে সরকারের ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হতো। সব জানার পরও এনসিটিবি কার্যত এটা ঠেকাতে উদ্যোগ নেয়নি। এটা ঠেকাতে চলতি বছর বিকল্প কিছু পদ্ধতিতে বইয়ের চাহিদা সংগ্রহ করে এনসিটিবি। এতে গত বছরের চেয়ে ৪ কোটি বই কম ছাপাতে হচ্ছে।

এনসিটিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, এনসিটিবির তৎকালীন সদস্য ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম গত জানুয়ারি মাস থেকে এই নিয়ে কাজ শুরু করে। তারা তিনটি ভিন্ন পদ্ধতিতে বইয়ের চাহিদা যাচাই করে। প্রথমে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চাহিদা পাঠানোর সময় সতর্ক থাকতে বলা হয় এবং অতিরিক্ত চাহিদার প্রমাণ মিললে শিক্ষকের এমপিও স্থগিতসহ কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এরপর মাঠ থেকে আসা চাহিদা শিক্ষাবোর্ড থেকে দ্বিতীয় দফায় মেলানো হয়। যেমন—নবম শ্রেণিতে নিবন্ধিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং সারা দেশ থেকে এই শ্রেণির জন্য আসা বইয়ের চাহিদা মিলিয়ে দেখা হয়। তৃতীয়টি ছিল এনসিটিবির নিজস্ব অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে একাধিক ধাপে তা যাচাই করা হয়। এ ছাড়া এনসিটিবি ৩২টি টিম গঠন করে সারা দেশে পাঠায়, যারা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দফায় দফায় মিটিং করেন এবং অতিরিক্ত চাহিদা প্রদান করলে কঠোর শাস্তির বার্তা দেন। এই কঠোর পদক্ষেপের ফলে শিক্ষক-কর্মকর্তারা সতর্ক হন এবং গত বছরের তুলনায় প্রায় ৪ কোটি বইয়ের চাহিদা কম আসে। এনসিটিবির উদ্যোগে ৪ কোটি অতিরিক্ত বই কমায় সাধুবাদ জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা।

এনসিটিবি কর্মকর্তা জানান, আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) বৈঠকে ২০২৬ সালের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা স্তরের বই ও কারিকুলামের অনুমোদন দেওয়া হবে।

এনসিটিবির বিতরণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে ১ কোটি ৯৫ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ২১ কোটি ৫৮ লাখ এবং প্রাথমিক স্তরে ২ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ৮ কোটি ৫২ লাখ, সব মিলিয়ে ৩০ কোটি ৩৭ লাখ বই ছাপানো হবে। গত বছর এই দুই স্তরে বই ছিল ৪০ কোটি ১২ লাখ। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ১০ কোটি বই কম ছাপাতে হচ্ছে। তবে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন কারিকুলাম বাতিল করায় দশম শ্রেণির জন্য নতুন করে ৫ কোটি ১৯ লাখ বই ছাপাতে হলেও এ বছর আর ছাপা হবে না। এ ছাড়া বাতিল হওয়া কারিকুলামে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে চারু ও কারুকলা, শারীরিক শিক্ষা এবং কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা আবশ্যিক বিষয় ছিল, কিন্তু এখন এগুলো ঐচ্ছিক হওয়ায় ৪০ লাখের মতো বই কম ছাপাতে হবে। এ বিষয়গুলো বাদ দিলেও প্রায় ৪ কোটির বেশি বই কমেছে। এই উদ্যোগ সরকারের আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি প্রতি বছর অতিরিক্ত বইয়ের যে চাহিদা আসত, সেই প্রবণতা বন্ধ হবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।

সূত্রমতে, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় জানুয়ারি মাসে দেওয়া বইয়ের চাহিদা দ্বিতীয় দফায় যাচাই করার পর বইয়ের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৮৫০টি কমেছে, যা পূর্বের চাহিদার চেয়ে ৩৩ শতাংশ কম। এনসিটিবি কর্মকর্তারা কালবেলাকে জানান, তারা এই উপজেলার মফস্বলের স্কুলগুলোয় বইয়ের তথ্য সংগ্রহের সময় মান ও সংখ্যা সরেজমিন যাচাই করতে গিয়ে ব্যাপক গরমিল পান। মাঠপর্যায়ের তথ্য পাওয়ার পর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে জানুয়ারি মাসে পাঠানো বইয়ের চাহিদা যাচাই করে ফের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সেই প্রতিবেদনে পূর্বের চাহিদার চেয়ে ৩৩ শতাংশ কম বইয়ের প্রয়োজন দেখা যায়। শুধু রাজাপুর নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলা থেকেই এভাবে অতিরিক্ত বইয়ের চাহিদা পাঠিয়ে প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি বেশি বই ছাপানো হয়।

রাজাপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোস্তফা আলম কালবেলাকে, এনসিটিবির নির্দেশনার পর প্রতিটি স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজিরা খাতায় শিক্ষার্থীর উপস্থিতির ভিত্তিতে আমরা বইয়ের হিসাব করেছি। এর সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ বই ধরেছি। কারণ কিছু বই নষ্ট হতে পারে বা নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে, যদিও এ সময়ে সাধারণত নতুন ভর্তি হয় না। তা সত্ত্বেও ৫ শতাংশ অতিরিক্ত বই ধরা হয়েছে। এতেও যে চাহিদা পাঠানো হয়েছে, তাতে ৩১ শতাংশের বেশি বইয়ের তথ্য পেয়েছি।

বইয়ের সংখ্যায় বড় ধরনের গরমিলের পর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সহায়তা চেয়েছে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এনসিটিবির চেয়ারম্যান সম্প্রতি মাউশির মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বইয়ের তথ্য ফের যাচাই করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এনসিটিবি ধারণা করছে, রাজাপুরের মতো সব উপজেলা থেকে চাহিদা ফের যাচাই-বাছাই করলে আরও ৫ থেকে ৮ শতাংশ অর্থাৎ এক থেকে দেড় কোটি বই কম লাগবে। এতে দরপত্রের পরও প্রয়োজন অনুযায়ী কম বই ছাপানো হবে।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খান কালবেলাকে জানান, এনসিটিবির চেয়ারম্যানের অনুরোধের পর তারা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর স্কুল থেকে বইয়ের প্রকৃত তথ্য পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হবে।

এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, চলতি বছর অতীতের মতো শুধু মাঠ থেকে আসা বইয়ের তথ্যের ওপর নির্ভর না করে তিনটি বিকল্প পদ্ধতিতে বইয়ের প্রকৃত তথ্য যাচাই করি। এ ছাড়া এনসিটিবি কর্মকর্তাদের প্রকৃত তথ্য জানতে প্রতিটি জেলায় পাঠায়। সব তথ্য এনসিটিবির নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে যাচাই করার ফলে গত বছরের চেয়ে চলতি বছর প্রায় ৪ কোটি বই কম ছাপাতে হচ্ছে। এতে সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকা সাশ্রয় হচ্ছে।

এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর রিয়াদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, গত বছর যখন আমরা দায়িত্ব নিই তখন আগের চাহিদা অনুযায়ী বই ছাপা হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর বইয়ের সংখ্যা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিই। প্রথমে আমরা শিক্ষাবোর্ড থেকে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ করি, এরপর আমাদের নিজস্ব অ্যাপসের মাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই-বাছাই করি। সর্বোপরি মাঠ থেকে পাঠানো তথ্য যেন প্রকৃত হয় সেজন্য উপজেলা-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের জুমে কয়েক দফা বৈঠক করে নির্দেশনা দিই। সেখানে কড়া বার্তা ছিল এমন, কেউ অতিরিক্ত বইয়ের তথ্য দিয়েছে এমন প্রমাণ মিললে প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন নির্দেশনায় মাঠের প্রকৃত তথ্যটা পেয়েছি। আশা করি এটি ভবিষ্যতের জন্য নমুনা হয়ে থাকবে।

এনসিটিবির তথ্যমতে, ২০২৫ সালে ৪ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ৪০ কোটি ১২ লাখ বই ছাপানো হয়। এর বিপরীতে ২০২৬ সালের জন্য ৪ কোটি ১৯ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ৩০ কোটি ১০ লাখ বইয়ের চাহিদা এসেছে। যদিও এ সংখ্যা ফের যাচাই হলে আরও কমতে পারে। ২০১০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ী, দাখিল ভোকেশনাল, এসএসসি ভোকেশনাল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে সরকার।