
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা , ইংরেজি ও গণিতে দক্ষতা ব্যাপকভাবে কমেছে । এর মধ্যে অষ্টম শ্রেণিতে বিজ্ঞানে ৪৮ শতাংশ এবং গণিতে ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর দক্ষতার মান বেশ খারাপ । শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ( মাউশি ) অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তৈরি ‘ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন -২০২৩ ' গবেষণা প্রতিবেদনের খসড়ায় এ চিত্র পাওয়া গেছে । প্রতিবেদনে ফল খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে করোনা মহামারি , প্রাকৃতিক দুর্যোগ , সামাজিক অস্থিরতা , দেরিতে শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়া এবং নতুন শিক্ষাক্রমের প্রচলনকে চিহ্নিত করা হয়েছে । এতে শিখন দক্ষতা বৃদ্ধিতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে ।
জানতে চাইলে মাউশির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক কাজী মো . আবু কাইয়ুম বলেন , ‘ অংশীজনদের নিয়ে কর্মশালার মাধ্যমে গবেষণা প্রতিবেদনটি শিগগির চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে । ” মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ শিগগির এ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে । প্রতি দুই বছর পর এ গবেষণা পরিচালিত হয় । দেশের মাধ্যমিক স্তরের ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অষ্টম ও দশম শ্রেণির ৫১ হাজার ১১৭ শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণা চালানো হয় । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল ৮১৫ টি বিদ্যালয় ও ১৮৫ টি মাদ্রাসা । অষ্টম শ্রেণির চার বিষয় ( বাংলা , ইংরেজি , গণিত ও বিজ্ঞান ) এবং দশম শ্রেণির তিন বিষয়ে ( বাংলা , ইংরেজি ও গণিত ) মূল্যায়ন পরীক্ষা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ।
২০২৪ সালের ১২ জুলাই আগের বছরের ওই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয় । শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এর প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল । প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের অর্জিত দক্ষতাকে পাঁচটি স্তরে ( ব্যান্ড ) ভাগ করে দেখানো হয়েছে । এর মধ্যে ব্যান্ড -২ খুবই খারাপ , ব্যান্ড -৩ খারাপ বা গড়পড়তা , ব্যান্ড -৪ মোটামুটি ভালো , ব্যান্ড -৫ ভালো এবং ব্যান্ড -৬ খুবই ভালো হিসেবে ধরা হয় । অষ্টমে গণিতের ফল খারাপ ৪৭ শতাংশের : গবেষণার তথ্য বলছে , অষ্টম শ্রেণির ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর গণিতে দক্ষতার অবস্থা খারাপ । এর মধ্যে ৯ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ , ৩৮ শতাংশ খারাপ বা গড়পড়তা । বাকি ৫৩ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশের অবস্থা মোটামুটি ভালো , ১৭ শতাংশ ভালো এবং খুবই ভালো স্তরে আছে মাত্র ৬ শতাংশ । তবে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অবস্থা কিছুটা ভালো । আর দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অবস্থা অষ্টম শ্রেণির চেয়ে তুলনামূলক ভালো । দশম শ্রেণির ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে খারাপ অবস্থায় আছে । এই শ্রেণিতে খুব খারাপ অবস্থায় কোনো শিক্ষার্থী নেই । ভালো অবস্থায় আছে ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ।
ইংরেজির অবস্থাও আশানুরূপ নয় : গবেষণায় দেখে গেছে , অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২২ শতাংশের ইংরেজির অবস্থা খারাপ । এর মধ্যে ৫ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ । আর ১৭ শতাংশের অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা । এ বিষয়ে দক্ষতা মোটামুটি ভালো থেকে খুব ভালো পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৭৮ শতাংশ । দশম শ্রেণির ইংরেজি শিক্ষার্থীর ৮৪ শতাংশের অবস্থা ভালো এবং ১৬ শতাংশের অবস্থা খারাপ । বাংলায় ২২ শতাংশের অবস্থা খারাপ : গবেষণার তথ্য বলছে , অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলায় ২২ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা খারাপ । এর মধ্যে ৫ শতাংশের অবস্থা খুবই খারাপ । ১৭ শতাংশের অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা । বাকি ৭৮ শতাংশের অবস্থা ভালো । দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলায় ১৬ শতাংশের অবস্থা খারাপ । আর বাকি ৮৪ শতাংশের অবস্থা
মোটামুটি থেকে খুব ভালো । অষ্টমে বিজ্ঞানে দুর্বল ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী : গবেষণা প্রতিবেদন বলছে , বিজ্ঞানে অষ্টম শ্রেণির ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা খুবই খারাপ এবং ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী খারাপ বা গড়পড়তা স্তরে আছে । এই দুই স্তর মেলালে অষ্টম শ্রেণির এ বিষয়ের ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থীরই অবস্থা খারাপ । মোটামুটি স্তরে আছে মাত্র ৩০ শতাংশ । বাকি ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী ভালো বা খুবই ভালো স্তরে আছে । কয়েক বছর আগের চেয়ে ফল খারাপ : গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা ইংরেজি ও গণিতে দক্ষতা কমেছে । করোনা মহামারির কারণে ‘ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন -২০২১ ' তৈরি হয়নি । তথ্য বলছে , ২০১৯ সালে বাংলায় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের স্কোর ছিল ৪৩৭ , যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪০৪ - এ । ইংরেজিতে স্কোর ছিল ৩৮৯ যা কমে হয়েছে ৩৭৯। গণিতে ২০১৯ সালে স্কোর ছিল ৪২৪ , যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯২ - এ । একইভাবে ২০১৯ সালে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলায় স্কোর ছিল ৪৬২ , যা কমে হয়েছে ৪১৩ , ইংরেজিতে ৪১৫ থেকে কমে হয়েছে ৪০২ আর গণিতে ২০১৯ সালে স্কোর ছিল ৪৫৮ , যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪২৫ - এ ।
এগিয়ে খুলনা, পিছিয়ে সিলেট : গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে , অষ্টম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা ও গণিতে ভালো করেছে খুলনা বিভাগের শিক্ষার্থীরা । ইংরেজিতে ভালো করেছে চট্টগ্রাম বিভাগের শিক্ষার্থীরা , বিজ্ঞানে রাজশাহী বিভাগের শিক্ষার্থীরা । আর সব বিষয়ে খারাপ ফল করেছে সিলেট বিভাগের শিক্ষার্থীরা । এ ছাড়া বাংলা ও ইংরেজিতে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ভালো করেছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে । শহরের শিক্ষার্থীরা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে সব বিষয়ে ভালো ফল করেছে । শিক্ষক ঘাটতির প্রভাব : শিক্ষাবিদদের মতে , দুর্যোগ - দুর্বিপাক এবং শিক্ষাক্রম ধরনের বিষয় ছাড়াও শিক্ষকের ঘাটতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার জন্য দায়ী । মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ( আইইআর ) অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান এমনটাই বললেন । তিনি বলেন , “ মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়গুলোতে গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই । অনেক প্রতিষ্ঠানে অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা এই বিষয়ের ক্লাস নেন । এর প্রভাব পড়েছে অষ্টম শ্রেণির গণিত ও বিজ্ঞানের ফলাফলে । ’
অধ্যাপক হাফিজুর রহমান আরও বলেন , ‘ শিখন ঘাটতি কমাতে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ , তাদের যথাযথ সুযোগ- সুবিধা দেওয়া ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে । এ ছাড়া দ্রুত শিখন মান বৃদ্ধিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে । '