
টাকার বিনিময়ে হাতবদল হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের অপরাধজগৎ। এর নিয়ন্ত্রণ এতদিন ছিল মজনুবাহিনীর হাতে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে এটা চলে গেছে আলিফ ওরফে দয়ালবাবার নিয়ন্ত্রণে। এক্ষেত্রে চুক্তি হয়েছে ৫৮ লাখ টাকার। এ টাকার বিনিময়ে ছয় মাস সুন্দরবনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে নতুন বাহিনীর হাতে। নতুন বাহিনীর প্রধান এর আগে মজনুবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কাজ করতেন। চুক্তি অনুযায়ী, মজনু ইতোমধ্যে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন দয়ালবাবার কাছ থেকে। বাকি টাকা পাবেন তিন মাসের মধ্যে। এরই মধ্যে কিছু অস্ত্র এবং গোলাবারুদ হস্তান্তর করে পার্শ্ববর্তী একটি দেশে পাড়ি জমিয়েছেন মজনু। যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে এসব তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যেসব জলদস্যু ও বনদস্যু ইতঃপূর্বে সরকারের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাদের অনেকেই আবার ফিরেছেন পুরোনো পেশায়। দয়ালবাবার নেতৃত্বাধীন দস্যুদলে এ মুহূর্তে নয়জন দস্যু আছে। এ নয়জনের মধ্যে চারজন আত্মসমর্পণ করে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা নিয়েছিলেন। এ চারজনের মধ্যে দয়ালবাবা ছাড়া খোকাবাবু এবং আব্দুল্লাহর নাম জানা গেছে।
আরও জানা যায়, সম্প্রতি শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ, রমজান নগর, কৈখালী ও ঈশ্বরিপুর ইউনিয়নের ১৫ জেলেকে অপহরণ করেছে দয়ালবাবা বাহিনী। মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা এরই মধ্যে ফিরে এসেছেন।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, সুন্দরবনের জলসীমা অধিকতর সুরক্ষার জন্য সম্প্রতি বয়াসিং এলাকায় ভাসমান বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) উদ্বোধন করা হয়েছে। বিজিবির এই বিওপি ছাড়াও সুন্দরবন এবং জেলেদের রক্ষায় র্যাব, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের লোকদের আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এতে অপরাধীদের তৎপরতা বন্ধ হবে।
সূত্র জানায়, অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ হাতবাদলের পর সাধারণ জেলেদের ওপর অন্যায়, অত্যাচার ও নির্যাতন বেড়ে গেছে। মজনুর নিয়ন্ত্রণাধীন সময়ে ছয় মাসের জন্য জেলেদের নৌকাপ্রতি ২৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হতো। এখন দিতে হচ্ছে ৩৫ হাজার টাকা করে। নির্ধারিত টাকা দিতে না পারলে জেলেদের ধরে নেওয়া হচ্ছে, চালানো হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ভিকটিমের মোবাইল ফোনে স্বজনদের শোনানো হচ্ছে আহাজারি।
সোনার মোড় মৎস্য আড়তের সাধারণ সম্পাদক আবিদ হাসান আবেদার বলেন, বনজীবীরা খুব বিপদে আছেন। বিভিন্ন বাহিনীর কাছে তারা জিম্মি দীর্ঘদিন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হয়েছিল সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে মোটেই দস্যুমুক্ত হয়নি। যেসব দস্যু আত্মসমর্পণ করেছে বলা হয়েছিল, তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে আগে যেমন অপকর্ম করেছে, এখনো করছে। এখন ডাকাতদের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ১২ মাসের মধ্যে পাঁচ মাস সরকারিভাবে সুন্দরবনে কর্মতৎপরতা বন্ধ থাকে। বাকি সাত মাসে যে টাকা রোজগার করে, তাতে মহাজন, বিভিন্ন বাহিনী ও দস্যুদের দেওয়ার পর পেট চলা কঠিন। এ অবস্থার পরিত্রাণ জরুরি।
পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, বিভিন্ন বাহিনী ও দস্যুদের অপতৎপরতা বন্ধে বন বিভাগের পক্ষ থেকে নরমাল টহলের পাশাপাশি স্মার্ট টিমের বিশেষ টহল জোরদার করা হয়েছে। কোস্ট গার্ডসহ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে কথা হয়েছে। যে কোনো সময় যৌথ অভিযান পারিচালনা করা হবে।
শ্যামনগর থানার ওসি হুমায়ুন কবির বলেন, দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সুন্দরবনের ওপর বিশেষ নজরদারি রেখেছেন। রাতে টহল বাড়িয়েছি। দস্যুতা সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়ামাত্রই আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন বলেন, জলদস্যু নির্মূলে উপজেলা প্রশাসন আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। সবশেষ আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কোনো দস্যুবাহিনীকেই সুন্দরবনে তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না।