
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান আন্দোলন বুধবার (২৮ মে) সকাল ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। বেলা ১০টার পর নির্ধারণ হবে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের চলমান আন্দোলনের ভাগ্য। অপরদিকে আন্দোলনরত কর্মচারীদের মধ্যে চাকরি হারানোর শঙ্কা ভর করেছে। তারা বলছেন, চলমান আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর, সরকার যদি চায়—তাহলে বিদ্যমান আইনের ধারায় তাদের চাকরি থেকে বহিষ্কারের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেও নিতে পারে। আন্দোলনের পাশাপাশি তারা এখন সেই শঙ্কায় আছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলছে, বুধবার (২৮ মে) সকালে অফিস শুরু হওয়ার পর ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদের নেতৃত্বে কয়েকজন সচিব মিলে আন্দোলনকারীদের দাবির বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে উপস্থাপন করবেন। বৈঠক শেষে তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অবস্থান সম্পর্কে আন্দোলনরত কর্মচারী নেতাদের অবহিত করবেন। এরপর আন্দোলনরত নেতারা সবকটি গ্রুপের সঙ্গে বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন।
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ ২০২৫ বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবার (২৭ মে) চতুর্থ দিনের মতো সকাল থেকেই সচিবালয়ের কর্মচারীরা নিজ নিজ দফতর থেকে বেরিয়ে এসে সমাবেশে অংশ নেন। তারা মিছিল নিয়ে চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে সমগ্র সচিবালয় প্রদক্ষিণ করেন। এমন সময় বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের উভয় অংশের নেতাদের কাছে প্রস্তাব আসে যে আন্দোলনরত কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ভূমি সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদসহ কয়েকজন সচিব আলোচনায় বসবেন। এমন সংবাদে নেতারা আন্দোলন কিছুটা শিথিল করে বেলা ২টার কিছু পরে ভূমি সচিবের দফতরে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষ করে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভূমি সচিব সাংবাদিকদের জানান—তারা কয়েকজন সচিব বসে তাদের (আন্দোলনকারীদের) বক্তব্য শুনেছেন। সচিব বলেন, আমরা আসলে উভয়পক্ষই সরকারের কর্মচারী। সরকার একটা আইন করেছে। এ বিষয় নিয়ে আন্দোলনকারীরা সংক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা আইনটি বাতিল চেয়েছেন। তাদের বক্তব্যের সারাংশ বুধবার (২৮ মে) আমরা সবাই একত্রে গিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে উপস্থাপন করবো। এরপরের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদের সচিবের মাধ্যমে নেবে সরকার। সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে তা আন্দোলনরত নেতাদের সকাল ১০টায় জানানো হবে।’
এমন সিদ্ধান্তের পর আন্দোলনরত কর্মচারী নেতারা জানিয়েছেন, আলোচনার স্বার্থে তারা চলমান কর্মসূচি বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত স্থগিত রাখবেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে ভূমি সচিবের নেতৃত্বে যে টিমটি বৈঠক করবেন, সেই টিমের বক্তব্য শোনার পর নেতারা বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন।
এদিকে আন্দোলনরত একাধিক কর্মচারী এবং সংযুক্ত পরিষদের নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সরকার দাবি মেনে নিলেও তাদের মধ্যে নতুন আতঙ্ক ভর করেছে। তা হলো চাকরি হারানোর আতঙ্ক। তারা বলেন, চলমান আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর সরকার যদি চায়, তাহলে বিদ্যমান আইনের ধারা অনুযায়ী, আমাদের চাকরি থেকে বহিষ্কারের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, আমাদের কী করার থাকবে। আমরা এখন সেই আতঙ্কে আছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। অবশ্যই কর্মচারীদের কাজে ফেরাতে হবে। সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর বাংলাদেশ সচিবালয় এভাবে চলতে পারে না। আমরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। বুধবার বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো। আশা করছি বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধানই হবে।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব নিজামউদ্দিন বলেন, ‘আমরা চলমান আন্দোলন বুধবার বেলা ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করেছি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্যারের সঙ্গে ভূমি সচিব স্যারের মিটিংয়ে কী দাঁড়ায়, তা জানার পর আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য বৈঠকে বসবো। সেখানেই আন্দোলনের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবো।’
এদিকে কর্মচারীদের এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সচিবালয়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দিন এখানে পুলিশ ও এপিবিএন সদস্য নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকলেও মঙ্গলবার (২৭ মে) মোতায়েন করা হয়েছে বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াট ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের।
সচিবালয় এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তার জন্য সকাল ৮টা থেকে পুলিশ, এপিবিএন, বিজিবি ও সোয়াট সদস্যরা উপস্থিত হন। পরে সকাল ১০টা ২০ মিনিট থেকে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন র্যাব সদস্যরাও। র্যাবের ডিএডি মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সচিবালয়ের নিরাপত্তার জন্য র্যাবের দুটি টিম টহলরত রয়েছে। আমরা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে আছি। সচিবালয়ের মূল ফটক ছাড়াও অন্যান্য ফটকেও সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মূল ফটকের অপরদিকে সড়কে রাখা রয়েছে সোয়াটের আর্মড ভেহিকল। এছাড়াও পুলিশের এপিসি কারও দেখা গেছে।
জানা গেছে, এর আগে মঙ্গলবার বিকাল পৌনে ৩টায় ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে ভূমি সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদের সভাপতিত্বে বৈঠক শুরু হয়। সভায় আরও পাঁচ জন সচিব অংশ নেন। এছাড়া সচিবালয়ে আন্দোলনরত কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা সভায় যোগ দেন। সচিবালয়ে কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে মঙ্গলবার সকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশিদ বেশ কয়েকজন সচিবকে নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। ওই সভায় সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সভা থেকেই কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে ভূমি সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অপরদিকে প্রশাসন ক্যাডারের ‘বৈষম্যমূলক আচরণের’ প্রতিবাদে সারা দেশে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা মঙ্গলবার (২৭ মে) কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করেছেন। ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর আহ্বানে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন দফতরে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কর্মসূচির আওতায় সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানানো হয়। একই দাবিতে বুধবার একই সময়ে সারা দেশে আবারও কলমবিরতি পালিত হবে।
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি বাদিউল কবীর বলেছেন, আমরা বর্তমান সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করতে চাই। আমরা সরকারের সঙ্গে আছি এবং থাকবো। তবে আমাদের দাবি ক্লিয়ার, আর তা হলো—কেবিনেটে অনুমোদন পাওয়া কালো আইন বাতিল করতে হবে। এর বাইরে কোনও সমাধান আমরা মানবো না।