
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় গতকালও বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ মিছিলে উত্তাল হয়েছে।
চতুর্থ দিনের মতো গতকাল সকাল থেকে স্লোগানে প্রকম্পিত হয় সচিবালয় এলাকা। কয়েক স্তরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও উত্তাল ছিল প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রটি। গতকাল দুপুরের পর ভূমি সচিবের নেতৃত্বে কয়েকজন সচিবের সঙ্গে আন্দোলনকারী কর্মচারী নেতারা বৈঠক করেন। আজ বুধবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ আন্দোলনরত কর্মচারীদের দাবির বিষয়গুলো তুলে ধরবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলন কর্মসূচি আজকের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। আন্দোলনে থাকা একাধিক নেতা বলেছেন, চাকরির অধ্যাদেশটি স্থগিত করতে পারে সরকার। তবে প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকবেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য গত শনিবার থেকে কাজ বন্ধ রেখে প্রতিদিন বিক্ষোভ করছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ক্যাডার কর্মকর্তা ছাড়া সবাই সরাসরি এই আন্দোলনে রয়েছেন। তবে ক্যাডার কর্মকর্তাদের মৌন সম্মতি রয়েছে। কেননা আইনটি সবার জন্য প্রযোজ্য।
গতকাল চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ মিছিল সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নতুন ভবনের সামনে জড়ো হন। কর্মচারীদের টানা আন্দোলনে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সচিবালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভে অংশ নিতে কাজ ফেলে নিচে নেমে আসেন।
গতকাল সকাল থেকে সচিবালয়ের ভিতরে ও বাইরে কয়েক স্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরাপত্তা দিতে দেখা যায়। সচিবালয়ের ভিতরে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা ছিল। আর বাইরেও পুলিশ-বিজিবি এবং সোয়াত টিমকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা এড়াতে গতকাল সকাল থেকে দর্শনার্থী প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। শুধু তা-ই নয় পূর্বঘোষণা ছাড়াই সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার দুপুর পর্যন্ত বন্ধ ছিল।
দুপুরের পর সচিবালয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদসহ কয়েকজন সচিবের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আন্দোলনকারী কর্মচারী নেতারা বৈঠক করেন। বৈঠকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, যুব ও ক্রীড়া সচিব উপস্থিত ছিলেন। আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো এখন মন্ত্রিপরিষদকে জানানো হবে। বৈঠকের পর আজকের আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত জানান আন্দোলনকারীরা।
বৈঠক শেষে বিকালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে। তাদের কথাগুলো সবাই শুনেছেন। বিষয়গুলো সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে জানানো হবে বুধবার (আজ)।
সিনিয়র সচিব বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আলোচনা করার জন্য এবং সমস্যার মূল কোথায় সেটা বের করার জন্য। আমরা আমাদের কথা বলেছি, তাদের কথা শুনেছি। যেহেতু অধ্যাদেশ বাতিল ওনারা তাড়াতাড়ি চান, আমরা ঠিক করেছি বুধবার সকাল ১০টায় সংশ্লিষ্ট সব সচিব মিলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এ কথাগুলো জানাব। তাদের দাবি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ঘোষণা আসবে। আর তারা আলোচনা চলার সময়ে আন্দোলন করবেন না। তাদের কর্মসূচি নাই, তারা এক দিন দেখবেন।’
অধ্যাদেশ বাতিল হবে কি না, জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘যে আইন হয়েছে, সে আইনের সঙ্গে আমরা সংশ্লিষ্ট না। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সরকার কী করবে, সেটা আমি এ মুহূর্তে বলতে পারছি না।’
বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর জানান, ‘আমরা কোনো আংশিক সংশোধন চাই না। পুরোপুরি বাতিল চাই। বুধবার (আজ) কর্মসূচি স্থগিত করেছি। আমাদের ধারণা ছয়-সাতজন সচিব যদি একসঙ্গে বলেন, তাহলে অধ্যাদেশ বাতিল হবে।’

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে বিষয়টি বলার পর আশা করি ভালো একটা ফল আসবে। ফলে বুধবার কোনো কর্মসূচি থাকবে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেছে সরকারি বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম।’ ফোরামের সভাপতি এ বি এম আবদুস ছাত্তার বলেন, অধ্যাদেশ স্থগিত করতে চায় সরকার। কিন্তু স্থগিতের আদেশের প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলেছে কি না, জানতে চাইলে জানতে চাইলে ঐক্য ফোরামের সভাপতি বলেন, ‘সরকার তো আমাদের কথা মানছে না। এক-দেড় ঘণ্টা আগে বলেছে তারা এটা স্থগিত করবে। কিন্তু আমরা বলেছি স্থগিতের আদেশ জারি করতে হবে। তারপর আমরা আন্দোলন উঠিয়ে নেব। এই আন্দোলনটা এখন আর সচিবালয়ে নাই, দেশের সব অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, সব সংস্থা, মাঠপর্যায়ের ডিসি অফিস, ইউএনও অফিস পর্যন্ত মাঠে।’
গতকাল ‘বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘কালো আইন’ বাতিলের দাবিতে কেন্দ্রীয় সচিবালয়সহ গোটা বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন ও একাত্বতা ঘোষণা করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিতর্কিত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের অনৈতিক সহযোগিতায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশিদ, জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান ও স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। এই তিনজন সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের দাবি জানানো হয়।
সারা দেশে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কলমবিরতি কর্মসূচি : সারা দেশে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা গতকাল কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করেন। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের আহ্বানে দেশের বিভিন্ন দপ্তরে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা এ কর্মসূচি পালন করেন। প্রশাসন ক্যাডার কর্তৃক বৈষম্যমূলকভাবে বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার প্রতিবাদে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।