Image description
গৃহকর্মীর আড়ালে কিশোরী পাচার

পেটের দায়ে, পরিবারের মুখে একটু হাসি ফোটাতে দেশ ছাড়ছেন বাংলাদেশের বহু নারী। কিন্তু স্বপ্নের বিদেশে পা রেখেই বদলে যাচ্ছে সেই স্বপ্নের রূপ। তারা প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন আর নিঃস্ব করে ফেলা এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার। এরপর এসব নারীর কেউ কেউ বিদেশ থেকে ফিরছেন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়, কেউ বা সদ্যোজাত সন্তান কোলে নিয়ে। দেশে ফিরে পরিবার ও সমাজের তির্যক দৃষ্টির শিকার হচ্ছেন তারা, হারাচ্ছেন ঠাঁই, সম্ভ্রম ও স্বীকৃতি—সবকিছুই। অথচ এ নারীরাই জীবন বাজি রেখে দেশের রেমিট্যান্সের চাকা সচল রেখেছেন।

এই মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে সক্রিয় রয়েছে একটি সুসংগঠিত পাচারকারী চক্র, যারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভুয়া কাগজপত্রে কিশোরীদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। দৈনিক কালবেলার দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ সব তথ্য—চক্রটির সঙ্গে জড়িত অন্তত চারজন বিএমইটি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) কর্মকর্তার সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। জড়িত রয়েছে অর্ধশতাধিক রিক্রুটিং এজেন্সি। প্রশিক্ষণ ছাড়াই, ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর ব্যবহার করে, প্রত্যাগত দেখিয়ে শত শত অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে পাঠানো হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে, যেখানে অনেকেই ঠাঁই পাচ্ছেন ডান্স বার, স্পা সেন্টার কিংবা গৃহকর্মীর ছদ্মবেশে নির্যাতনের ভেতরে।

পাচার হওয়া নারীদের প্রায় ৫০০টি পাসপোর্ট নম্বর এখন কালবেলার হাতে। এ সংখ্যাই শেষ নয়—প্রতিদিনই গৃহকর্মীর আড়ালে নতুন নতুন কিশোরী পাড়ি দিচ্ছেন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। অভিবাসনের নামে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরে লুকিয়ে থাকা এই মানব পাচার এখনই না থামালে—গন্তব্যের নাম শুধুই অন্ধকার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএমইটিকেন্দ্রিক চক্রটির প্রধান পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মাসুদ রানা। এ ছাড়া চক্রটিতে রয়েছেন বহির্গমন শাখার পরিচালক (উপসচিব) মামুন সরদার ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল হাই। আর পর্দার আড়ালে থেকে এসব কর্মকর্তাকে সহায়তা করেন মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর।

জানা যায়, নির্যাতিত ও নিপীড়িত হওয়া নারীদের সঠিক সংখ্যা কারও কাছে নেই। তবে নির্যাতিত হয়ে ফেরা নারীদের একটা হিসাব রাখে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম বা ওকাপ। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে যেসব নারী সহায়তা চান বেসরকারি ওই সংস্থাটির কাছে, শুধু তাদের হিসাবই রয়েছে। সে হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংস্থাটি প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি বিদেশফেরত নারীকে সহায়তা করেছে। সংস্থাটি বিমানবন্দরে ৪০ জন অসুস্থ নারীকে সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে ৭ জনের অবস্থা ছিল গুরুতর। এ ছাড়া মানসিক সাপোর্ট ৩০৪ জনকে, রেইস প্রকল্পের আওতায় ৪ হাজার ৮৭৮ নারীকে আর্থসামাজিক সহায়তা, ১৭৮ নারীকে আশ্রয় প্রদান, ১৫০ জনকে স্বাস্থ্য সহায়তা ও ৪৬ জনকে আইনি সহায়তা দিয়েছে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম।

তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে কোনো নারীকে বিদেশে পাঠানোর একটি নীতিমালা রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শাখা-৫ থেকে ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। পরিপত্রে মোট ১৯টি নির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে ৭ নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গৃহকর্মী হিসেবে গমনেচ্ছু মহিলাদের বয়স ন্যূনতম ২৫ বছর হতে হবে। ৯ নম্বরে ন্যূনতম ১৫ দিন প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে কেউ পূর্বে গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে থাকলে অর্থাৎ প্রত্যাগত হলে তার বেলায় ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ লাগবে না। তবে অনুসন্ধানে কালবেলার হাতে এমন শত শত পাসপোর্ট এসেছে যাদের বয়স ২৫ হয়নি, কোনো কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণও নেননি আর বিদেশফেরতও নন; তবুও বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পেয়েছেন। বিএমইটির এমন অন্তত ৫ শতাধিক ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট কালবেলার হাতে রয়েছে। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো—অনেক ক্ষেত্রে নামে নামে মিল এমন ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর বসিয়ে প্রত্যাগত দেখিয়েও নেওয়া হয়েছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির ক্লিয়ারেন্স। কোথাও আবার চালাকি করে ‘হাউস ওয়ার্কারের’ জায়গায় লেখা হয়েছে শুধু ‘ওয়ার্কার’। বেশিরভাগ নারীর বয়সই ১৮ পেরোয়নি। বয়স বাড়িয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বানানো হয়েছে পাসপোর্ট। এ ছাড়া পাসপোর্টের ইমার্জেন্সি কন্ট্রাক্টে সাধারণত পরিবারের নম্বর দেওয়ার কথা। তবে শত শত পাসপোর্টের ইমার্জেন্সি কন্ট্রাক্টে ফোন দিয়ে দেখা যায়, তার প্রায় সবই ভুয়া। বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স দেওয়া ফোন নম্বর বেশিরভাগই বিভিন্ন দালালের। ফলে এসব নারী বিদেশে গিয়ে প্রতারণার শিকার হলে দূতাবাসের পক্ষে তাদের ট্রেস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হলে এসব কিশোরীর বয়সের বিষয়টি ধরা পড়ে যেতে পারে। যে কারণে প্রশিক্ষণ ছাড়াই নামে নামে মিল এমন ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর বসিয়ে দেখানো হয়েছে প্রত্যাগত। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সরকারি পাসপোর্ট ভান্ডারের তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এমন প্রায় তিনশ পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছে কালবেলা। তাতে দেখা গেছে, বিদেশে পাঠানো কিশোরীর নাম মিললেও বাবা-মা এমনকি ঠিকানা মেলেনি। মেলেনি জন্ম তারিখও। এ ছাড়া প্রত্যাগত পাসপোর্টের ছবির সঙ্গেও চলতি পাসপোর্টের ছবির কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এসব নারীর বয়স পাসপোর্টে ২৫-এর আশপাশে দেখানোয় তাদের পক্ষে বিদেশফেরত হওয়াও সম্ভব নয়। কারণ সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ২৫ বছরের আগে কোনো নারী গৃহকর্মীর ভিসায় বিদেশ যেতে পারেন না।

অনুসন্ধানে ভয়াবহ পাসপোর্ট জলিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে কালবেলা। গত ১৭ মার্চ মো. জোসনা বেগম নামের এক নারী বিএমইটির ছাড়পত্র পান। যার পাসপোর্ট নম্বর এ১৬০৫৮৩৪৬ ও ভিসা নম্বর ১৯০৬৮৫৭৯৬৮। পিতার নাম মোফাজ্জল প্রামাণিক ও মাতার নাম মোসা. মনোয়ারা বেগম। এই নারীর পাসপোর্টে পূর্ববর্তী আরও একটি পাসপোর্টের নম্বর দেওয়া। যেটি হলো—ইজি০৭২৭২৪০। এই নারী কোনো প্রশিক্ষণ নেননি। পুরোনো একটি পাসপোর্ট যুক্ত করে প্রত্যাগত দেখিয়েছেন। তবে তার পুরোনো পাসপোর্টটি খুঁজে বের করে দেখা গেছে, সেটি জোসনা বেগম নামের এই নারীর নয়। ইজি০৭২৭২৪০ নম্বরের পাসপোর্টের মালিকের নাম জোসনা বেগম হলেও তার বাবার নাম আব্বাস আলী ও মাতার নাম গেদিজান। এ ছাড়া দুজনের ঠিকানা ও ছবিতেও অমিল রয়েছে। ২০ মার্চ সৌদি আরবের জন্য ছাড়পত্র নিয়েছেন মোসা মাহমুদা আক্তার শান্তা নামের এক নারী। যার পাসপোর্ট নম্বর—এ১৭৪৯৯২৫১ ও ভিসা নম্বর ১৯০৬৭৮৯১৭৮। এই নারী প্রশিক্ষণ না নিয়ে প্রত্যাগত দেখিয়েছেন। সেখানে তিনি পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর লিখেছেন—ইই০৪৬৯৫১৪। তবে কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাসপোর্টের মালিক মোসা. মাহমুদা আক্তার নামের অন্য এক নারী। এই নারী ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি সৌদি যেতে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন। যার ভিসা নম্বর: ৬০৭২৩৮৩৯২৪। এ দুই নারীর বাবা, মা ও ঠিকানায় অমিল রয়েছে। একইভাবে গত ১৭ মার্চ প্রশিক্ষণ ছাড়াই ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর নিয়ে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন রোমা আক্তার নামের আরেক নারী। যার পাসপোর্ট নম্বর—এ১১২২৭০৫২ ও ভিসা নম্বর: ১৯০৬৫৩৪৭৮৯। পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর দেওয়া—এ০২৪০৭০২৬। এই নারীর বাবার নাম মো. জহির মিয়া ও মাতার নাম মোসা. রোফিয়া খাতুন। তবে পূর্ববর্তী পাসপোর্টের রোমা আক্তার বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২। যার ভিসা নম্বর: ৬০৭৬৭০৯৬১০। এই নারীর বাবার নাম আফসার শেখ ও মাতার নাম সালেহা বেগম। গত ১৯ মার্চ সুলতানা আক্তার নামের এক নারী সৌদি আরবের যেতে গৃহকর্মীর ভিসায় ছাড়পত্র পান। যার পাসপোর্ট নম্বর—এ০৮৭৬৪৩৭৯, পূর্ববতী পাসপোর্ট নম্বর—এ০২৪১৬৬৭৩। বাবার নাম খালেক বেপারি ও মায়ের নাম রিনা বেগম। তবে অনুসন্ধানে পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বরটি নকল দেখা গেছে। এ০২৪০৭০২৬ পাসপোর্ট দিয়ে সুলতানা আক্তার নামের এক নারী ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন। ভিসা নম্বর: ৬০৭৬৭৯৭০৭৪। এই নারীর বাবার নাম মনোহর আলী খান ও মাতার নাম দুর্লব চান বিবি। একইভাবে রুপা আক্তার ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৯ মার্চ। যার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৭৩৭৪২৯২। পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর ভুয়া: এ০৯১০৩৬৭৫। রেহানা আক্তার তুলি ছাড়পত্র পেয়েছেন ১৯ মার্চ। ভিসা নম্বর: ১৯০৬৮৫৯৮৯৯। তার পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর ভুয়া: এ০১৩০৭৪০০। ওই নারী ছাড়পত্র নিয়েছেন ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর। দুজনের পিতার-মাতার নাম ও ছবিতে কোনো মিল নেই। গত ১১ মার্চ সৌদি যেতে ছাড়পত্র নিয়েছেন রাজশাহীর নওগাঁর মো. পারভিন নামের এক নারী। যার পিতার নাম মো. বাঙ্গরা ও মাতার নাম মোসা. হানিফা। পাসপোর্ট নম্বর এ১৬৮২৬৬৭৮ ও পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর: ইবি০৭৮২১২৬। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বরটি আসল নয়। এই পাসপোর্ট দিয়ে মোসা পারভীন নামের এক নারী ২০২২ সালে ১৬ আগস্ট ছাড়পত্র নিয়েছেন। তার ভিসা নম্বর: ৬০৮২৩২৯৯৩০। এ দুই নারীর বাবা-মায়ের নাম ও ঠিকানায়ও গরমিল রয়েছে। ৯ মার্চ মোসা খাতিজা খাতুন নামের এক নারী ছাড়পত্র নিয়েছেন। যার পাসপোর্ট নম্বর: এ০৯০২৪৯৮৬। ভিসা নম্বর ৬১৩৭৬৫২৮০৮। পূর্ববর্তী পাসপোর্ট: বি০০৩৭৯৮৭৮ নম্বরটি আসল নয়। খাতিজা খাতুনের বাড়ি সাতক্ষীরা হলেও পূর্ববর্তী পাসপোর্টের খাতিজা খাতুনের বাড়ি খুলনা। এ ছাড়া দুজনের বাবা-মা, জন্মতারিখ ও ছবি এক নয়। একই রকমভাবে মানসুরার পাসপোর্ট নম্বর এ১৬৮১৩৭৪৯ ও ভিসা নম্বর ৬১৩৭০৭৬৩৯৮। পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর: ইএ০৬৪২৪০৫ ভুয়া। লাকি বেগম ৯ মার্চ বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন। তার পাসপোর্ট নম্বর এ১৭৪১৯৭১৫। তবে পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর: বিকে০০৫৯৭৩৩ ভুয়া।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, গত ১১ মার্চ বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র পান আফরিন জাহান নামের এক নারী। যার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৭৩৮৫৪০২ ও ভিসা নম্বর: ৬১৩৬১০১৫৯৬। পাসপোর্টে এই নারীর জন্মতারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০০৩। বিএমইটির ক্লিয়ারেন্সের সময় এই নারীর বয়স হয়েছিল ২১ বছর ১০ মাস ১ দিন। হাউস কিপিং ভিসায় বিদেশে গেলেও এই নারী গ্রহণ করেননি কোনো প্রশিক্ষণ। নিয়মানুযায়ী ২৫ বছর না হওয়ায় এই নারীর ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার কথা নয়। গত ২৩ মার্চ জর্ডানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র পান পাখি আক্তার নামের আর এক নারী। যার পাসপোর্ট নম্বর : এ০১০২০৬০৭ ও ভিসা নম্বর: ৭৮৩৯৯৪। পাসপোর্টে এই নারীর জন্মতারিখ ১৬ জুন ২০০৩। ছাড়পত্রের সময় এই নারীর বয়স ২১ বছর ৮ মাস ২৭ দিন। অর্থাৎ সরকার নির্ধারিত ২৫ বছর হয়নি। একই দিন শান্তা আক্তার নামে আরও এক নারী ছাড়পত্র পেয়েছেন। যার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৬৫৯৩৬২৮ ও ভিসা নম্বর: ৭৮৪৬১৫। ছাড়পত্রের সময় এই নারীর বয়সও ২৫ হয়নি। ২৩ মার্চ পাখি আক্তার নামের আরও এক নারী ছাড়পত্র পেয়েছেন। যার পাসপোর্ট নম্বর : এ১৭৮৫৫৭৬৫ ও ভিসা নম্বর: ৭৮৩৩০৮। হাউস কিপিং ভিসায় ছাড়পত্র নিয়ে জর্ডান গেলেও এই নারীর বয়স ২৫ হয়নি, নেননি প্রশিক্ষণ। গত ১৬ মার্চ বিএমইটির ছাড়পত্র পেয়েছেন মোসা. জনি আক্তার নামের এক নারী। এই নারী কাতারের উদ্দেশ্যে গৃহকর্মীর ভিসার ছাড়পত্র নিয়েছেন। যার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৩৯৪২২১২ ও ভিসা নম্বর: ৩৪২০২৫০০০৮৭৮। ছাড়পত্রের সময় এই নারীর বয়স ২৫ হয়নি। গত ২৫ মার্চ হালুচিং মারমা নামের এক নারী হংকংয়ে হাউস কিপিং ভিসায় বিএমইটির ছাড়পত্র পেয়েছেন। তার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৪৯১৬৯৮৯ ও ভিসা নম্বর: ইএইচইএফ-৪০০৩৭৭৯-২৫ (সি)। এই নারীর বয়স ২৩ বছর ২ মাস। ২০ মার্চ এ১৬৬৭৪১৯৪ পাসপোর্টের এক নারী ছাড়পত্র পেয়েছেন। তার ভিসা নম্বর: ইএইচইএফ-১০৭৮১৫৬-২৫(৯)। ছাড়পত্রের সময় পাসপোর্ট অনুযায়ী এই নারীর বয়স ২২ বছর ১২ দিন। তাদের সবাই প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট ছাড়াই বিএমইটির ছাড়পত্র পেয়েছেন। একইভাবে বয়স হয়নি। জালিয়াতি করে বয়স বাড়ানো হলেও প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেট নেই। জালজালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিদেশ গেছেন—এমন শত শত পাসপোর্ট রয়েছে কালবেলার হাতে। যার মধ্যে কয়েকটি হলো এ০৮৭৪৪৬৮৬, এ১৭৬১০৯৬৭, এ১৬৯৪৩০৬২, এ১৭৩৯৪৮৭৩, এ১৬২৯১৮১৯, এ১৭৬১০৯৬৮, এ১৬০১৯৭৬৭, এ১৭১৯৭৯৭৫, এ১৭১৫২৯৩৪, ইজে০৯১৬৪২৪, এ১১২২৭০৫২, এ১১২২৭০৫২, এ০২৪০৭০২৬, এ১৫৩০৩৭০০, এ১৬২৬৬৮০২, এ০৮৭৭৮১৩৯, এ১৬৭২৭৭৪১, এ০১০২০৬০৭, এ০২৪৫০৮০৮, এ০১০২০৬০৭, এ০২৪৫০৮০৮, এ১৫৪৮৮৮৮২, এ১৬২০২৮৭১, এ১৬৪৫৩৫২৫, এ০২৪৬০৮৫৬, এ১৬৪৫৩৫২৫, এ১৬৪৫৩৫২৫, এ০২১৪৪৪৬২, এ১৬২০২৮৭১, এ১৭৬৯২৮৩৮, এ১৭৬৯২৮৩৮, এ১৬৪০৪৩৫৩, এ১৭৭৩৭৪৫৯, এ০৭০০৬৭১৮, এ১৩৩১৯৪৬৯, এ১৭৪৭৫৭৩২, এ১৭৩৬৬৯৮০, এ১৪৭৩৭১১৩, এ১৬৪৪৮১৭৬, এ১৭১৩২৭৪১, এ১২৬০৪৭৪৫, এ১৫১৪১৮২৯, এ১৭২৫৯০৩৪, এ০২০৩৪১৩২, এ১৭১৬৩২৪৭, এ১৩৭০৬৫৩৬, এ১৫১৪১৮২৯, এ১৭২৫৯০৩৪, এ১৭৪৭২৩০২, এ১৭৫৫০০৩৫, ইই০৮০০৪০৫, এ১৭৩৫৬২৪০, ইই০৮০৬৮৮২, এ১৪৬২০৬৮৮, এ১৪৬২০৬৮৮, এ১১২১০৩২৫, এ্১২৭১৩৯৮৮, এ১৬৮২০১৬১, এ১৭১১০৬০৭, এ১৬১৬২৯৭৮, এ১৭২১৯১১৪, এ১৭৩১৫৬৯২, এ১৭৩২৯০২৫, এ১৬৬২০৬৩১, এ১৭৩৮৫৪০২, এ১৪৬১৩৩১৯, এ১৪৯৯৭৭২৩, এ১৬৭২৩৩৯৮, এ১৭০৪৭৫৭২, এ১২৭০০৭৩৮, এ১৭০৪০৫৬৭, এ১৪৮০৭৭১৮, এ১৬৮৪৮১৮৫, এ০৮৬৫১৪৯৫, এ১৬৭৯২৩৯৯।

নিয়মানুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বিএমইটির ছাড়পত্র পেতে হলে তার ফাইল অন্তত ছয়টি দপ্তর থেকে চেক করার কথা। ছয়টি দপ্তরের কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব ফাইল অনুমোদন হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। নিয়মানুযায়ী প্রথমে প্রবাসে গমনেচ্ছু ব্যক্তির ফাইল তোলা হয় সংশ্লিষ্ট সেকশনে। এরপর সেখান থেকে যায় সংশ্লিষ্ট শাখার সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দপ্তরে। আর সব শেষে এসব ফাইলের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন মহাপরিচালক। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা জড়িত না থাকলে এসব ফাইল অনুমোদন হওয়া এক প্রকার অসম্ভব।

বিএমইটিতে জালিয়াতির মাফিয়া ৪ কর্মকর্তা: বিএমইটির দায়িত্ব বিদেশে যাওয়া কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষা। সেই বিএমইটিই কর্মীদের ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ বিপদের মুখে। কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরীদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঠেলে দিচ্ছে দূরদেশে। আর এই চক্রে খোদ বিএমইটির অন্তত চারজন কর্মকর্তার সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে। চক্রটির প্রধান বিএমইটির পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মাসুদ রানা। বিএমইটির নিজস্ব এই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে সংস্থাটিতে কর্মরত। মাসুদ রানা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি নিতে নিতে বাগিয়ে নেন পরিচালকের পদ। এখন অতিরিক্ত মহাপরিচালকের পদ ভাগাতে তদবির করছেন বিভিন্ন দপ্তরে। বিএমইটিতে ব্যক্তি স্বার্থে আঘাত এলে মাসুদ রানা তার আজ্ঞাবহ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের দিয়ে আন্দোলন করান। এরপর সংস্থাটির ঊর্ধ্বতনদের চাপে ফেলে পূরণ করেন তার খায়েশ। এমন প্রমাণও রয়েছে কালবেলার হাতে। এ ছাড়া মাসুদ রানার সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চক্রটিতে আরও আছেন বহির্গমন শাখার পরিচালক (উপসিচব) মামুন সরদার, অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল হাই। এই অতিরিক্ত মহাপরিচালক আগেও বহির্গমন শাখার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। আর এই চক্রটির সব অনৈতিক আবদার মেনে তাদের কাজের বৈধতা দেন স্বয়ং বিএমইটির মহাপরিচালক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিএমইটির বহির্গমন শাখা থেকে মামুন সরদারকে সরিয়ে কর্মসংস্থান শাখায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর কর্মসংস্থান শাখা থেকে মোহাম্মদ মামুন মিয়াকে সরিয়ে এনে দায়িত্ব দেওয়া হয় বহির্গমন শাখায়। তবে মামুন মিয়া নিয়মবহির্ভূত কোনো ফাইল স্বাক্ষর করতে রাজি না হওয়ায় বিএমইটিতে একটি পাতানো আন্দোলন করা হয়। আন্দোলনের একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা বিএমইটির ডিজির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে আন্দোলনকারীদের পক্ষে বক্তব্য দেন মেসার্স এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (আরএল নম্বর:০৪৬৯) এর মালিক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে বিএমইটির অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধান করায় এই আন্দোলনের ওপরে তীক্ষ্ণ নজর ছিল কালবেলার। তারই ধারাবাহিকতায় কৌশলে ডিজির সঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের বৈঠকের পুরো ভিডিও সংগ্রহ করে কালবেলা। ডিজিকে উদ্দেশ ভিডিওতে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে একপর্যায়ে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা বহির্গমন থেকে কোনো ছাড়পত্র পাচ্ছি না। এখানে এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো। আমরা আগে যেভাবে ম্যানপাওয়ার নিছি সেভাবে প্রতিদিন ম্যানপাওয়ার নেওয়া সম্ভব। আমরা বলছি—আপনি মাসুদ রানা স্যার ও আব্দুল হাই স্যারকে নিয়ে দুই সদস্যের কমিটি করে দায়িত্ব দেন। তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমি বিলিভ করতে পারি, আমি বিশ্বাস করতে পারি তাদের দ্বারা সম্ভব। ডেথ সাইন করে যামু—আপনারা যদি এই দুজনের পরামর্শ দেন….। আমাদের এমন অবস্থা হয়ে গেছে যদি আজকের দিনের মধ্যে আপনারা আমাদের সমাধান না করেন, তাহলে আমরা উপদেষ্টার কাছে যেতে বাধ্য হমু।’ যেই কথা সেই কাজ। এরপর একই দিন বহির্গমন শাখায় পরিচালক হিসেবে মোহাম্মদ মামুন মিয়া (উপসচিব) দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় নতুন করে আরও দুজনকে পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা বিএমইটির ইতিহাসে নজিরবিহীন। একই শাখায় তিনজন পরিচালক এর আগে কখনো বিএমইটিতে দায়িত্ব পালন করেননি। গত ৫ মার্চ সেই চিঠি স্বাক্ষর করেন উপপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। চিঠিতে মো. মাসুদ রানাকে সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশের অফ লাইন/হার্ডফাইল বহির্গমন-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর মামুন সরদারকে দেওয়া হয় সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশের অনলাইন বহির্গমন-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দায়িত্ব পাওয়ার পরই শত শত ফাইল নিয়মবহির্ভূত অনুমোদন করেন মাসুদ রানা ও মামুন সরদার গং। যার শত শত ছাড়পত্রের কপি রয়েছে কালবেলার হাতে। এ ছাড়া ডিজির সঙ্গে বৈঠকে বক্তব্য দেওয়া মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (আরএল নম্বর:০৪৬৯) নথিপত্র বের করেছি আমরা। সেখানে দেখা গেছে, মাসুদ রানা দায়িত্ব পাওয়ার পরই এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়মবহির্ভূতভাবে অসংখ্য ফাইল অনুমোদন পেয়েছে। যার মধ্যে ৯ মার্চ মোসা. খাতিজা খাতুন নামের এক নারী এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ছাড়পত্র নিয়েছেন। যার পাসপোর্ট নম্বর—এ০৯০২৪৯৮৬। ভিসা নম্বর ৬১৩৭৬৫২৮০৮। পূর্ববতী পাসপোর্ট: বি০০৩৭৯৮৭৮। বাবার নাম মো. জামাল উদ্দিন ও মাতার নাম মোসা. মাসুরা খাতুন। ঠিকানা সাতক্ষীরা সদর। পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে আমরা পূর্বের পাসপোর্টটি বের করেছি। সেখানে দেখা গেছে এই দুই পাসপোর্টের নারী একই নামের হলেও একই ব্যক্তি নন। পূর্বের পাসপোর্টের নারীর নাম খাদিজা খাতুন। তবে বাবার নাম মৃত মো. সবির হোসেন মোল্লা ও মাতার নাম মোসা. রাবেয়া বেগম। স্থায়ী ঠিকানা খুলনা। এই নারী ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন। যার ভিসা নম্বর : ৬০৮৩১৮০৭৪২। এ ছাড়া এই দুই নারীর জন্ম তারিখও ঠিক নেই। ঠিক নেই রিক্রুটিং এজেন্সির নামও। এ ছাড়া গত ১১ মার্চ সৌদি যেতে ছাড়পত্র নিয়েছেন রাজশাহীর নওগাঁওয়ের মো. পারভিন নামের এক নারী। যার পিতার নাম মো. বাঙ্গরা ও মাতার নাম মোসা. হানিফা। পাসপোর্ট নম্বর এ১৬৮২৬৬৭৮ ও পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর: ইবি০৭৮২১২৬। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বরটি আসল নয়। এই পাসপোর্ট দিয়ে মোসা. পারভীন নামের এক নারী ২০২২ সালে ১৬ আগস্ট ছাড়পত্র নিয়েছেন। তার ভিসা নম্বর: ৬০৮২৩২৯৯৩০। এই নারীর বাবার নাম জয়নাল এবং মাতার নাম হাজেরা বেগম। এ ছাড়া ঠিকানা, দুজনের ছবি ও জন্মতারিখ এক নয়। একই রকমভাবে মানসুরা পাসপোর্ট নম্বর: এ১৬৮১৩৭৪৯ ও ভিসা নম্বর: ৬১৩৭০৭৬৩৯৮। পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর: ইএ০৬৪২৪০৫। পূর্ববর্তী এই পাসপোর্টের বিপরীতে বিএমইটির সার্ভারে কোনো ডাটা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এই পাসপোর্ট নম্বরটিও ভুয়া। কারণ এই পাসপোর্ট দিয়ে কেউ বিদেশে গেলে তার সমস্ত তথ্য সার্ভারে থাকত। এ ছাড়া লাকি বেগম নামের এক নারী ৯ মার্চ বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন। তার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৭৪১৯৭১৫ ও ভিসা নম্বর: ৬১৩৮১৪৭৫৯৬। পূর্ববতী পাসপোর্ট নম্বর: বিকে০০৫৯৭৩৩। এই পাসপোর্ট দিয়ে এই নারী ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন। এই দুই নারীর পিতা, মাতা, ঠিকানা, জন্মতারিখ ও ছবি—কোনোকিছুই এক নয়। এ ছাড়া গত ১৭ মার্চ এইচ এ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির থেকে সাফিয়া বেগম নামের এক নারী বিএমইটির ছাড়পত্র পান। যার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৭৩৫২৬৫০ ও ভিসা নম্বর: ৬১৩৮৩৮৪৯৮৭। তবে এই নারী প্রশিক্ষণ করেননি, নেই কোনো প্রত্যাগত পাসপোর্ট। একই দিন বিদেশ ফেরত না হয়েও কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই ছাড়পত্র পেয়েছেন মোসা. রতনা খাতুন নামের আরও এক নারী। যার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৬০২৭৩২২ ও ভিসা নম্বর: ৬১৩৮২০২১৮৩। এরকম আরও বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট ও বিএমইটির ছাড়পত্র রয়েছে কালবেলার হাতে।

জালিয়াতির এখানেই শেষ নয়। এরপর গত ৫ মার্চ সেই চিঠি নিয়ে বিএমইটিতে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। বিধিবহির্ভূতভাবে একই পদে তিনজনকে দায়িত্বে দেওয়ায় তাজ্জব বনে যান সংশ্লিষ্টরা। এরপর ২২ এপ্রিল এক চিঠিতে ৫ মার্চের চিঠিটি বাতিল করা হয়। ২২ এপ্রিলের চিঠিতে বলা হয়, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন শাখার কার্যক্রম একাধিক পরিচালকের পরিবর্তে পরিচালক (বহির্গমন) এর মাধ্যমে সম্পাদিত হবে। তবে এর ঠিক ১২ দিন পর ৪ মে ফের মোহাম্মদ মামুন মিয়াকে বহির্গমন শাখা থেকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় মামুন সরদারকে। এরপরই আবার শুরু হয় একই কায়দায় জালজালিয়াতি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১১ মে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নেন শিমু আক্তার তালুকদার নামের এক নারী, যার পাসপোর্ট নম্বর: এ১৬৭৩২৩৫৫ ও ভিসা নম্বর: ৬১৪০৫৯০৩৮৩। পূর্ববতী পাসপোর্ট নম্বর: বিটি০২৮৮২৫৮। এই নারীর বাবার নাম মো. শাহ আলম ও মাতার নাম মোসা. নাজমুন নাহার। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বরে নারী একই নামের হলেও একই ব্যক্তি নন। পূর্ববর্তী পাসপোর্টের ওই ছাড়পত্র নিয়েছেন ২০১৮ সালের ৩১ মে। তার বাবার নাম মো. ইব্রাহিম মিয়া ও মায়ের নাম মোসা. বকুর আক্তার। তাদের ঠিকানা ছবি ও জন্ম তারিখেও রয়েছে গরমিল। একই দিন বিউটি আক্তার নামের আরও এক নারী সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে এ১৪৮৪৬৮৯৪ পাসপোর্টের বিপরীতে ছাড়পত্র পান, যার ভিসা নম্বর: ৬১৩৮১৯৯৯৪৫। পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নম্বর: এ১২৮০৫৪৮৫। তবে পূর্ববর্তী পাসপোর্টটি চেক করে দেখা গেছে সেটি সঠিক নয়। এই পাসপোর্ট দিয়ে গত বছরের ৩ জানুয়ারি বিউটি আক্তার নামের আর এক নারী বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন, যার ভিসা নম্বর: ৬১০৮০৪৯৬০৩। এই দুই নারীর বাবা, মায়ের নাম, ঠিকানা ও জন্ম তারিখ এক নয়। একই দিন আফসানা জাহান নামের আর এক নারী এ১৬৮১০৩২৯ পাসপোর্টের বিপরীতে একটি ছাড়পত্র নিয়েছেন। এই নারীরও এ০১৮১১৭৫৩ নম্বরের একটি ভুয়া পূর্ববর্তী পাসপোর্ট দেখিয়েছেন। পূর্ববর্তী এ০১৮১১৭৫৩ এই পাসপোর্টটি দিয়ে আফসানা বেগম নামের এক নারী ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি ওমানের উদ্দেশ্যে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়েছেন। তাদের বাবা, মায়ের নাম-ঠিকানা ও জন্ম তারিখও এক নয়। এরকম আরও বেশ কিছু পাসপোর্ট রয়েছে কালবেলার হাতে। যেগুলো মামুন সরদার বহির্গমন বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পরে অনুমোদন করা হয়েছে। একই দিন অনুমোদিত এ১৬৮৮৪৬৫০ পাসপোর্টের নারীর ছাড়পত্রে কৌশল করে লেখা হয়েছে ‘ওয়ার্কার’। তবে এই নারীর ভিসা সংগ্রহ করে দেখা গেছে সেখানে লেখা রয়েছে ‘হাউস ওয়ার্কার’। এ ছাড়াও একই সময় পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নেই, কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণও নেননি—এমন নারীদেরও দেওয়া হয়েছে বিএমইটির ছাড়পত্র। এমন আরও কিছু নারীর পাসপোর্ট নম্বর হলো—এ০৭২৮৬৬২১, এ১৬৮৮৪৬৫০, এ১৬৬৩০৬০২, এ১৬৬৫৮৭০৩, এ১৭৩৬৬৯২৫, এ১৭৫৫০৩৪২, এ১৭৭২৭০৪১, এ১৬০৫১৪৫৯, এ১৭৮১৪২৫১, এ১৬০৪২৯৮৮, এ১৭২১৫৬৭৬, এ১৭৮৬৩৫০৬, এ০৮৯৪২২৭৬, এ১৭৮৬৩৫০৬।

নিরাপদ মাইগ্রেশনের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে অনেক বড় রাজনৈতিক উইল বা সদিচ্ছা লাগবে এবং আমাদের সিস্টেমকে ডেভেলপ করতে হবে। আর একটি বিষয় হলো— রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কোনো বিচার হয় না। এখন মালয়েশিয়া নিয়ে যেটা হলো, সেটা কিন্তু এখনই প্রথম নয়। এ ধরনের ঘটনা ২০০৩ সালে ঘটেছে, ২০০৭ সালে ঘটেছে। বিগত সময়েও ঘটেছে। তবে কখনোই কারও বিচার হয়নি। এখানে বায়রা খুব শক্তিশালী। বায়রা সবসময়ই সব সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে। এখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বিজনেস। তাই সব দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।’ তিনি বলেন, আমাদের অনুসন্ধানেও আমরা ১৫ শতাংশ নারী প্রশিক্ষণ ছাড়াই সার্টিফিকেট এবং ছাড়পত্র পায়, এমন প্রমাণ পেয়েছি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মাসুদ রানা প্রশ্ন শুনেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আপনি তো কিছুই জানেন না। আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? কথা তো মনে হয় গড়গড়াইয়া বলতেছেন। মুখস্থ কথা বলছেন কেন।’ আমি এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করছি—আমার তো সব মুখস্থই বললে তিনি বলেন, আপনার পরিচয় তো আমি জানি না। আপনি কালবেলার পরিচয় দিয়ে এভাবে কথা বললেন। আমি ৩ বছর ধরে ইমিগ্রেশনে নেই। গত জুনে আপনাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, চিঠি আছে—এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো ভুয়া। এরপর তিনি ফোন কেটে দেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বহির্গমন শাখার পরিচালক মামুন সরদার নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে কালবেলাকে বলেন, ‘আপনারা প্রমাণ দেন। আমরা ব্যবস্থা নেব।’ অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হাই প্রশ্ন শুনে কালবেলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কথা আপনি কেন বলবেন। আমি সরকারি কর্মকর্তা, যুগ্ম সচিব। আমি এ ধরনের কাজ কেন করব। আপনারা সাংবাদিক কখন যে কী প্রশ্ন করেন। আপনি আমাকে এভাবে কেন বলবেন? আপনার কাছে প্রমাণ থাকলে আপনি দুদকে পাঠান। আমার নিয়োগকারী দপ্তরে পাঠান—বলে তিনি ফোন কেটে দেন। তবে মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর প্রশ্ন লিখে মেসেজ পাঠালেও তিনি কোনো রেসপন্স করেননি।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এতবড় প্রতারণা একা কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। এখানে সরকারি কর্মকর্তা, রিক্রুটিং এজেন্সি, বিএমইটি, পাসপোর্টসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা জড়িত। তারা নিজেরো লাভবান হতে অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সেখানে গিয়ে এসব নারী বিভিন্ন নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। এই চক্রে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়াও যেসব নারী না বুঝে বিদেশে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাষ্ট্রকে।’