Image description
নিপীড়ককে রক্ষায় চাপ

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-দুবাই ফ্লাইট। মাঝ আকাশে যাত্রীসেবার পর তখন কিছুটা ব্যস্ততা কমেছে কেবিন ক্রুদের। তখনই ফ্লাইট পার্সার আবদুর রহমান সুমন নিজের কাছে ডেকে নেন এক নারী কেবিন ক্রুকে (ফ্লাইট স্টুয়ার্ড)। কানের কাছে এসে ফিসফিস করে নানা যৌন নিপীড়নমূলক কথা বলতে থাকেন। এতে বিব্রত হন নারী কেবিন ক্রু, পেশাদারিত্ব বজায় রেখে করেন মৃদু প্রতিবাদও। এর পরও দমে জাননি সুমন। নারী সহকর্মীর শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ নিয়েও নানা মন্তব্য করেন। একপর্যায়ে বলতে থাকেন, ‘আমরা বাবা এবং মেয়ের মতো আমি তোমাকে আমার বিছানায় ডাকছি না…।’

গত ১ মে বিজি ০১৪৭ ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে দুবাই যায়; ৩ মে ফিরতি ফ্লাইটে দুবাই থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকায় আসে। ওই ফ্লাইটেই দায়িত্বরত অবস্থায় ঘটে নারী সহকর্মীকে নিপীড়নের মতো ভয়ংকর ঘটনা। অভিযুক্ত সুমন সেদিন ফ্লাইটটির প্রধান কেবিন ক্রুর দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার শিকার নারীর লিখিত অভিযোগ এবং বিমান সংশ্লিষ্ট সূত্রে মিলেছে এ তথ্য।

বিমানের ওই নারী কর্মী যৌন নিপীড়নের বিষয়টি জানিয়ে গত ৪ মে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাহকসেবা পরিদপ্তরে ইমেইলে লিখিত অভিযোগটি দেন। এর কপি ফ্লাইট সেফটি বিভাগেও দেওয়া হয়। তবে অভিযোগের পর থেকে হুমকি পাচ্ছেন ওই নারী ক্রু। তাকে অভিযোগটি তুলে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অভিযুক্ত সুমনের পক্ষে বিমানের একটি শক্তিশালী গ্রুপ নীতিনির্ধারকের কাছে ধরনা দিয়ে বিষয়টি চেপে যেতেও অনুরোধ করছে বলে জানা গেছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ওই নারী কেবিন ক্রুর অভিযোগটি তদন্ত পর্যন্ত শুরু হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগটি বিমানের সংশ্লিষ্ট নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটিতে পাঠানোর কথা থাকলেও তা পাঠানো হয়নি। সুমন প্রভাবশালী হওয়ায় উল্টো সেটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

বিমানের ফ্লাইট পার্সার বিভাগের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ঘটনাটি বিমানের সবাই জানেন। লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযুক্ত সুমনকে টানা পাঁচ দিন দায়িত্ব থেকে বাইরে রাখা হয়। তবে বিমানের কেবিন ক্রু ইউনিয়নের কিছু নেতার চাপে তাকে ফের ফ্লাইটে দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, নারী নিপীড়নের মতো ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েও ঢাকা-রোম-ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইটে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট শুরুর আগে কেবিন ক্রুদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে যে ব্রিফিং দেওয়া হয়, সেই ব্রিফিং ফ্লাইটেও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

ওই কর্মকর্তা বলেন, বিমানে নারী-সংক্রান্ত বিষয়ে এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় চাকরিচ্যুত, বরখাস্ত এবং ওএসডির মতো শাস্তির ঘটনা রয়েছে। কিন্তু স্পর্শকাতর ঘটনাটিতে সুমনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ। এমন পরিস্থিতিতে বিমানের নারী কর্মীদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে এক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

ঘটনার শিকার নারী লিখিত অভিযোগে বলেছেন, তিনি ফ্লাইটটির চিফ পার্সার সুমনের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অযাচিত আচরণের শিকার হয়েছেন, যা তার জন্য একটি প্রতিকূল এবং অস্বস্তিকর কর্মপরিবেশ তৈরি করেছে। সুমন ফ্লাইটের মধ্যে অনুমতি ছাড়াই হঠাৎ করে তার কাছে এসে ফিসফিস করে বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলেন। এতে তিনি ফ্লাইটে অনিরাপদ বোধ করেছেন এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

ওই নারী বলেন, পার্সার সুমন তার সঙ্গে খুবই অসামঞ্জস্য কথাবার্তা বলছিলেন। তিনি তাকে বলেছেন, ‘আমরা বাবা এবং মেয়ের মতো, আমি তোমাকে আমার বিছানায় ডাকছি না।’ তিনি অন্য পুরুষ সহকর্মীদের সামনে আমার শরীরের কিছু সংবেদনশীল অংশ নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন এবং অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে নানা বিষয় জিজ্ঞাসা করেন।

অবশ্য অভিযুক্ত আবদুর রহমান সুমন কালবেলাকে বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি আমি শুনেছি, কিন্তু কী অভিযোগ জানি না। অফিস থেকে আমাকে কিছু জানায়নি।’ অভিযোগের বিষয়ে জানালে তিনি বলেন, ‘ইন ফ্লাইটে অভিযোগ দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি।’

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাহকসেবা পরিদপ্তর থেকে যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়নি, তা বেরিয়ে আসে অভিযুক্ত সুমনের কণ্ঠেই। তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হলে কী হবে, শাস্তি হবে!’

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গ্রাহকসেবা পরিদপ্তরের পরিচালক মো. রাশেদুল করিম কালবেলাকে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না। কর্মক্ষেত্রে একজন নারী সহকর্মীকে নিপীড়নের অভিযোগ পাওয়ার পরও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এবং নারী নিপীড়নে অভিযুক্ত কর্মীকে ফের ফ্লাইটের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট করে জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে বিমানের মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

পরে কথা হয় বিমানের মুখপাত্র ও জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এবিএম রওশন কবীরের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, অভিযোগটির যাচাই-বাছাই চলছে। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ফ্লাইটে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, ঘটনাটি প্রাথমিক যাচাইয়ে রয়েছে।

বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস সূত্র বলছে, এর আগেও ফ্লাইট পার্সার সুমনের মাধ্যমে যৌন হয়রানির বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নারী কর্মীরা কাস্টমার সার্ভিস বিভাগে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছিলেন। তিনি প্রভাবশালী হওয়ায় এসব অভিযোগ কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি কখনো। চাকরি জীবনের শুরুর দিকেও এক নারী ক্রুকে যৌন হয়রানির ঘটনায় বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল সুমনকে।