Image description
জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬

প্রথমবারের মতো আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেটে অসচ্ছল চা শ্রমিকদের জন্য ‘মাসিক নগদ ভাতা’ চালু হচ্ছে। প্রতি মাসে ৬৫০ টাকা করে দেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার শ্রমিককে। এছাড়া চা শ্রমিকদের সন্তানের জন্য ‘শিক্ষা উপবৃত্তি’ চালু হচ্ছে। সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী পাবে এই উপবৃত্তির সুবিধা। অনগ্রসর জীবন প্রথা থেকে বের করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অদক্ষ শ্রমিকদের নানা বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ সহায়তা দেওয়া হবে এক হাজার ৫০০ জনকে। পিছিয়ে পড়া চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আসন্ন বাজেটে বড় ধরনের এই তিনটি কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা।

অর্থ বিভাগ থেকে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। এজন্য নতুন বাজেটে কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে ১১২ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আগামী বাজেটে সার্বিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমবে না, বরং বাড়ছে। কোনো কোনো ভাতার অঙ্কও বাড়ানো হচ্ছে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ডাটাবেজ করা হবে। এটি করতে পারলে প্রকৃত উপকারভোগীর সঠিক সংখ্যা মিলবে, একই সঙ্গে অনেক ভুয়া উপকারভোগী বাদ পড়বে তালিকা থেকে। ফলে সঠিক উপকারভোগীর ভাতার অঙ্ক বর্তমানের তুলনায় আরও বাড়ানো সম্ভব হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি স্কুলগুলো এমপিওভুক্ত হলে একজন শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম তিন হাজার টাকা বছরের শুরুতে দিতে হচ্ছে। নামীদামি স্কুলের শিক্ষার্থীরা দিতে পারলেও চা শ্রমিকদের সন্তানরা কীভাবে এ অর্থ দেবে। ওরা হচ্ছে বিত্তহীন মানুষের সন্তান। চা শ্রমিকদের সন্তানরা বই ফ্রি পাচ্ছেন। এর পরও ওই পরিবারগুলো তাদের সন্তানের পেছনে বছরের শুরুতে শিক্ষা খাতে ১৩ হাজার টাকা ব্যয় করছে। এ অর্থ দিয়ে স্কুলের পোশাক, খাতা কলম, স্কুলে নাম তোলাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটানো হয়। এ হিসাব ওই পরিবারগুলো আমাকে দিয়েছে। এটি যদি হয় তাহলে কীভাবে চা শ্রমিকের সন্তানরা শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হবে। এজন্য তাদের অনগ্রসর জীবন থেকে বের করে আনতে উপবৃত্তি বাড়াতে হবে।

আগামী ২ জুন সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা দেওয়া হবে। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে অর্থ বিভাগ। মূল্যস্ফীতির কারণে অন্তর্বর্তী সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।

সূত্র জানায়, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আসন্ন বাজেটে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি চালু হবে। যদিও বর্তমান ৬০ হাজার শ্রমিককে বছরে এককালীন ছয় হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এজন্য চলতি বাজেটে বরাদ্দ আছে মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। তবে আগামী জুলাই থেকে এককালীন আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি বন্ধ করা হবে। সেখানে তাদের জীবনমান উন্নয়নে আরও বড় ধরনের তিনটি কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। আর এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিদ্যমান ৩৬ কোটি টাকা থেকে বরাদ্দ বেড়ে ১১২ কোটি টাকায় উন্নীত হবে।

সূত্র আরও জানায়, বিগত সময়ে চা শ্রমিকদের সন্তানরা কোনো ধরনের শিক্ষা উপবৃত্তির আওতায় ছিল না। আগামী অর্থবছর থেকে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে দুই হাজার জন, প্রতি মাসে ৭০০ টাকা হারে, মাধ্যমিক স্তরে দেওয়া হবে এক হাজার ৫০০ জনকে, প্রতি মাসে ৮০০ টাকা হারে। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে চা শ্রমিকের এক হাজার সন্তানকে মাসিক এক হাজার টাকা এবং উচ্চতর স্তরে দেওয়া হবে ৫০০ জনকে। তাদের উপবৃত্তির অঙ্ক মাসিক এক হাজার ২০০ টাকা। এ জন্য বরাদ্দ থাকছে এক কোটি ৭০ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ইসিডি নেটওয়ার্কের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। যে কারণে সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার হার যেখানে ৯৫ শতাংশের উপরে, সেখানে চা বাগান অঞ্চলের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার হার ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সারা দেশের তুলনায় এসব অঞ্চলে ২০ শতাংশেরও অধিক শিশু প্রাথমিকের আগেই ঝরে পড়ে। আর বাকি ১০ শতাংশ ঝরে পড়ে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে।

চা শ্রমিকদের মতে, বাগানের স্কুলগুলোতে সরকার থেকে কোনো ধরনের শিক্ষা উপকরণ কিংবা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে না । এছাড়াও স্কুলের ফি, বইপত্র, খাতা কিনতে অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ জোগাড় করতে না পেরে অনেকেই তাদের সন্তানকে ঋণ করে লেখাপড়া করাচ্ছেন। মজুরি অনেক কম হওয়ায় চা শ্রমিকদের বলতে গেলে সবাই ঋণগ্রস্ত। তারা বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছে। প্রতি সপ্তাহেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। ফলে তাদের মজুরির টাকাও ঘরে নিতে পারেন না।

অনেক চা শ্রমিকই বাড়তি উপার্জনের আশায় অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদেরও পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করছেন। এভাবে পরবর্তী প্রজন্মও চা শ্রমিক হিসাবেই বড় হচ্ছে। দারিদ্র্যের গোলকধাঁধায় থেকেই কেটে যায় তাদের বাকি জীবন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘের ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, সিলেটের চা বাগানের প্রায় ৭৪ শতাংশ শ্রমিক এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। একবিংশ শতাব্দীর স্মার্ট যুগে এসেও চা শ্রমিকদের সর্বোচ্চ মজুরি ১৭০ টাকা। আর সপ্তাহে তাদের দেওয়া হয় মাত্র তিন কেজি আটা। এ নিয়ে শত হতাশা, দুঃখ চা শ্রমিকদের। এসব চা শ্রমিকের কারও ঘরে পাঁচজনের সংসার, কারও সংসার আটজনের। সংসারে কাজ করছেন এক বা দুজন। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের বাজারে আগুন। তাই খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয় অসংখ্য চা শ্রমিককে।

এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বাজেটে এক লাখ ৩৭ হাজার চা শ্রমিককে মাসিক নগদ ভাতা দেওয়ার ঘোষণা আসছে। প্রতিজন শ্রমিক মাসিক ভাতা পাবেন ৬৫০ টাকা করে। এ খাতে বরাদ্দ থাকছে ১০৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, দেশে সব মিলিয়ে চা বাগান ২৫৬টি। এর মধ্যে বাণিজ্যিক চা বাগানের সংখ্যা ১৬৮টি। এসব চা বাগানে নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা এক লাখ ৩৭ হাজারের বেশি।