Image description
লিস্ট করে নারীদের ধর্ষণ করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা । বিচারের অপেক্ষায় ৭ বছর, দ্রুত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের দাবি ।

সুবিচারের আশায় প্রায় ৭ বছর ধরে আর্তনাদ করছেন এক গৃহবধূ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে স্বামী-সন্তানদের বেঁধে হতদরিদ্র ওই গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। শুধু তাই নয়, ওই নারীর হাত-পা ভেঙে সারা শরীরে ছুরি-ব্লেড দিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। তার ‘অপরাধ’ তিনি বিএনপি করেন, ধানের শীষে ভোট দেন। গৃহবধূ এখনো সেই বর্বর নির্যাতনের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এখনো মাঝরাতে আতঙ্কে ঘুম ভাঙে তার।

শুধু ওই গৃহবধূই নয়, সেই রাতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা আরও অনেক নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল। সুবর্ণচর ৫নং চরজুবলী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সংসদ নির্বাচনের রাতে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপি তথা বিরোধীদের পরিবারের নারীদের টার্গেট করে নির্যাতন চালায়। কোন কোন নারীকে ধর্ষণ করা হবে এ রকম একটি লিস্টও করে তারা। পরে দলবেঁধে তাদের ওপর আক্রমণ করে। তিনি বলেন, ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ এখনো আতঙ্কে আছেন। চূড়ান্ত বিচার না হওয়া পর্যন্ত তিনিসহ (গৃহবধূ) গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরবে না।

সম্প্রতি ওই গৃহবধূর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, স্বামী-সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে তাদের জীবন কাটছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ভয়ে তারা ঘর থেকেও তেমন বের হন না। দুই মেয়ে বড় হয়েছে, এখন তাদের নিয়েও আতঙ্ক বাড়ছে।

ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ জানান, ওই রাতে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন, হাসান আলী দুলু, সোহেল, ইব্রাহিম খলিল, জসিম উদ্দিনসহ ১৫-২০ জন তার ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বর্বর নির্যাতন চালায়। জ্ঞানহারা অবস্থায়ও শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত করে। আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ভয়ে এখনো ঘুমাতে পারেন না তিনি। সন্ধ্যার আগেই পরিবারের সদস্যরা ঘরে ঢুকে পড়েন। মামলার বাদী তার স্বামী। তাকে বহুবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। এক সময় তাদের নিরাপত্তায় পুলিশি পাহারা ছিল, এখন তাও নেই।

গৃহবধূ আরও জানান, আসামি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের আত্মীয়স্বনজদের বসবাস গৃহবধূর বাড়ির আশপাশেই। ফলে প্রতিদিনই হুমকি আসত মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। পুলিশ প্রশাসনও আসামিদের হয়ে কাজ করত। নিরাপত্তায় পাহারার বদলে পুলিশ আসামিদের স্বজন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকত, আড্ডা দিত। তিনি বলেন, আসামিরা জেলে থাকলেও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা বাইরে রয়েছে। তারা হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। সাত বছর হয়ে গেল এখনো চূড়ান্ত বিচার পাইনি। দ্রুত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

গৃহবধূর স্বামী যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানুষ নয়। তারা হিংস জানোয়ারের চেয়েও জঘন্য। ওই রাতে শুধু আমার স্ত্রী নয়, আরও অনেক নারীকে নির্যাতন করেছে তারা। ভয়ে কেউ টুঁ শব্দও করেনি। এখনো আমার স্ত্রী সেই ভয়ংকর নির্যাতনের ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি। রাতে ঘুমের মধ্যে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠেন সে। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমার ওপরও বেশ কয়েকবার হামলা করেছে। পুলিশের সহযোগিতা পাইনি। তিনি বলেন, পুলিশ প্রায় বছরখানেক ধরে কোনো খোঁজখবরই নেয় না। ওসিকে ফোন করলেও ধরেন না।

স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলার ভয়ে বাড়ির পুরুষরা পালিয়ে বেড়াতেন। অনেকে দিনের পর দিন গ্রামছাড়া ছিলেন। সেই সুযোগে তারা নারীদের ওপর নির্যাতন চালাত।

জানা যায়, সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন মেম্বারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অভিযোগপত্র দেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক জাকির হোসেন। পুলিশ ১৫ আসামিকে গ্রেফতার করে। পলাতক রয়েছে মিন্টু নামের এক আসামি। ২০২৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক (জেলা জজ) ফাতেমা ফেরদৌস ১০ জনের ফাঁসি ও ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। আসামিদের মধ্যে মো. রুহুল আমিন, মো. হাসান আলী বুলু, মো. সোহেল, স্বপন, ইব্রাহিম খলিল, আবুল হোসেন আবু, মো. সালাউদ্দিন, মো. জসিম উদ্দিন, মো. মুরাদ ও মো. জামাল ওরফে হেঞ্জু মাঝির সর্বোচ্চ সাজার রায় হয়েছে। আর মো. হানিফ, মো. চৌধুরী, মো. বাদশা আলম বসু, মোশারফ ও মো. মিন্টু ওরফে হেলালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।

সুবর্ণচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন মিয়া যুগান্তরকে জানান, তিনি ৫ আগস্টের পর এ থানায় যোগদান করেন। এ সময়ের মধ্যে যতটুকু জেনেছেন-রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আসামিরা এলাকায় ধর্ষণসহ নানা অপরাধ করে বেড়াত। সাধারণ মানুষের কাছে তারা ছিল ত্রাস। ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলে জানান তিনি।

নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. আবদুল্লাহ আল ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ধর্ষণের ঘটনাটি খুবই বর্বর। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা যা প্রয়োজন করা হবে। এখন কেন নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না তা খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত করা হবে।