
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক অভিযান চালালেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর বিভিন্ন কার্যালয়ে ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। সংস্থায় ঘুষ বাণিজ্য বহু আগে থেকেই চলছে। অবস্থা এমন যে ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সেবাগ্রহীতাদের চাপে নিজেই দুর্নীতির কথা প্রকাশ্যে তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ওই দিন তিনি বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে গিয়ে সেই কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনরত উপপরিচালক মো. মাসুদ আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিলেন। ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সেবাদানের দুরবস্থা তুলে ধরে বলেছিলেন : মাসুদ তুমি ভালো হয়ে যাও। তারপর অবশ্য সেই মাসুদের পদোন্নতি হয়েছিল। এখন সেই মাসুদ বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে পরিচালক পদে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ে পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন।
সব মিলিয়ে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের ১৩টি ও সিলেট বিভাগের চারটি মিলে মোট ১৭টি কার্যালয়ের মূল কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার এই কার্যালয়গুলোয় চলছে অবাধ ঘুষ বাণিজ্য। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মাসুদ এখনো ভালো হননি। অন্যদিকে রাজশাহী বিআরটিএতে চক্র গড়ে আবেদন আটকে ঘুষ নিতেন সহকারী পরিচালক আব্দুর রশিদ। তাঁকে সুনামগঞ্জে বদলি করার পর থেকে কাজে মন বসছে না।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে উপপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) ছিলেন মাসুদ। ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি তাঁকে নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। ঝড় ওঠানো সেই মাসুদ বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে কী করছেন? সেবাগ্রহীতারা কি নির্বিঘ্নে সেবা নিতে পারছেন? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে অবাধেই বিভিন্ন চক্র ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস, নিবন্ধনসহ বিভিন্ন খাতে গ্রাহকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন ঘুষ না দিলে।
মাসুদকে লক্ষ করে ওবায়দুল কাদেরের ছোড়া মন্তব্য এখনো অনেকের মুখে মুখে। বিষয়টি নিয়ে এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে মুখ খোলেননি মাসুদ। প্রশ্ন উঠেছে তিনি কি আগের মতোই আছেন, নাকি ভালো হয়ে গেছেন? তাঁর সহকর্মীসহ অনেকে বলেছেন, সেই মাসুদ অতীতের ‘বদনাম’ বদলের চেষ্টা করছেন। তবে এখনো পর্যন্ত তিনি ভালো হননি। কারণ যেখানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন এবং যেসব কার্যালয়ের মূল দায়িত্বে আছেন, সেগুলোয় দুর্নীতি-অনিয়ম চলছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে সেবাগ্রহীতাদের সেবা নিতে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ প্রতিরোধে মাসুদ নানা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে ঘুষ বন্ধ হতে দেখা যায়নি। গত ৭ মে থেকে দফায় দফায় বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে গিয়ে পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. মাসুদ আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামে আসার আগে মাসুদ ২০২২ সালের ২১ জুন খুলনা বিআরটিএর বিভাগীয় পরিচালকের দায়িত্ব পান। সেখানেও তাঁর দায়িত্বকালীন খুলনা বিআরটিএতে ঘুষ বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। তারপর চট্টগ্রামে বিভাগীয় কার্যালয়ে বিভাগীয় পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েই চট্টগ্রাম বিআরটিএতে গ্রাহকের ভোগান্তি শূন্য কোঠায় নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত ৭ মে দুদক বিআরটিএর ৩৫ কার্যালয়ে অভিযান চালায়। মাসুদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিআরটিএ সিলেট কার্যালয়েও অভিযান চলে। অভিযানে কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনের কক্ষের আলমারি থেকে হাবিবা এন্টারপ্রাইজের স্বাক্ষরযুক্ত ব্যাংকের ব্ল্যাংক চেকের পাতা, একাধিক মোবাইল ফোন ও হকিস্টিক উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ না দিলে হকিস্টিক দিয়ে নির্যাতন করতেন সেখানকার মোটরযান পরিদর্শক।
রশিদের পকেট ভারী : ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল বিআরটিএ রাজশাহী কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক পদে যোগ দেন আব্দুর রশিদ। যোগদানের পর সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহাদত আলী শাহুর নেতৃত্বে চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্র মূলত ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন আটকে রেখে ঘুষ নিত। ঘুষ না দিলে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর ফাইল আটকে রাখতেন রশিদ। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে অফিসের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরোধও তৈরি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রাজশাহী থেকে সুনামগঞ্জ বিআরটিএতে বদলি করা হলেও রাজশাহী ছাড়তে চাননি রশিদ। পরে জোর করে তাঁকে সুনামগঞ্জ পাঠানো হয়। রশিদচক্র এখনো আছে রাজশাহীতে। কয়েক দিন আগে বিআরটিএ রাজশাহী কার্যালয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানে এ তথ্যই পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সংস্থার রাজশাহী কার্যালয়ে দিনে গড়ে অনলাইনে ১০০ আবেদন জমা পড়ে। বিপরীতে সপ্তাহে বড়জোর দুই দিন পরীক্ষা নেওয়া হয়। আবেদনকারীদের মুঠোফোনে পরীক্ষার তারিখ জানিয়ে দেওয়া হয়। সেখানকার বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনে সরকারি খাসজমিতে তিনটি দোকান থেকে চক্র কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই মেলে চিকিৎসকদের সত্যায়ন করা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট। ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা নেওয়ার জন্য পাঁচ সদস্যের বোর্ড আছে। এটির সভাপতি রাজশাহী জেলা প্রশাসকের মনোনীত প্রতিনিধি। সদস্যসচিব বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক। বোর্ডের তিন সদস্য হলেন—সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি, রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি ও রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইনস্ট্রাক্টর। পরীক্ষা শেষে পাঁচ সদস্যের কমিটি অনুমোদন দেওয়ার পর মেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স। রশিদ সাবেক কাউন্সিলর শাহাদত আলী শাহুর ছত্রচ্ছায়ায় এ কমিটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। অনলাইনে আবেদনকারীর সব ফাইল পর্যবেক্ষণ করে উত্তীর্ণের তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব থাকে সহকারী পরিচালকের ওপর। এই সুযোগে রশিদ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। রশিদ ভারী যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে আট থেকে ১০ হাজার, হালকা লাইসেন্সের জন্য পাঁচ থেকে আট হাজার এবং মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্সের জন্য দেড় থেকে তিন হাজার টাকা ঘুষ আদায় করতেন। রাজশাহী বিআরটিএ অফিসের সামনে কম্পিউটারের দোকান খুলে বেশির ভাগ ঘুষ বাণিজ্য লেনদেন করে তাঁর তৈরি করা চক্র। ভুক্তভোগী আবু বাক্কার জানান, তিনি বিআরটিএতে তাঁর পরিচিত এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসন্সের জন্য আবেদন করে পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। তার পরও তাঁর ফাইলে সামান্য ভুল ধরে তিন মাস আটকে রেখেছিলেন রশিদ। পরে তিন হাজার টাকা দিয়ে ফাইল ছাড় করান তিনি। সেবাগ্রহীতারা জানান, পরীক্ষায় পাস করতে হলে বেশির ভাগ প্রার্থীকে ঘুষ দিতে হয়। রশিদচক্রের মাধ্যমে টাকা পেলে ফাইল ছেড়ে দেওয়া হতো। শেষ পর্যন্ত উচ্চমান সহকারী ফরিদ উদ্দিনকে দিয়ে ঘুষ বাণিজ্যের চক্রে যুক্ত করেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত গত ২২ এপ্রিল অনেকটা জোর করেই রাজশাহী থেকে বিতাড়িত করা হয় রশিদকে। বিআরটিএর রাজশাহী বিভাগীয় উপপরিচালকের নির্দেশে তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। রাজশাহী বিআরটিএতে যোগদানের আগে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সড়ক নিরাপত্তা শাখায় তিনি কর্মরত ছিলেন। আব্দুর রশিদ সুনামগঞ্জ বিআরটিএতে সহকারী পরিচালক পদেই যোগ দিয়েছেন গত ২৭ এপ্রিল। তাঁর যোগদানের পর সেখানে কাজে মনোযোগ না থাকার অভিযোগ করেছেন তাঁর সহকর্মীরা।
রশিদের স্ত্রী সালমা আক্তার কুসুমের নামে এসএস এন্টারপ্রাইজ ও এপেলবি নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। ঢাকার পূর্বাচল, উত্তরা ও ঝিলমিল প্রকল্পে প্লট ছাড়াও সাভারের আমিনবাজার ও নারায়ণগঞ্জে তিনটি স্থানে জমি আছে। রাঙামাটিতে সাততলা আবাসিক হোটেলের মালিক রশিদ। স্ত্রীর নামে আছে দুটি গাড়ি (ঢাকা মেট্রো চ-১৩-৯২৯২ ও ঢাকা মেট্রো গ-১১-৫২১৪)। জানতে চাইলে আব্দুল রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি রাজশাহীর শাহু নামের কোনো কাউন্সিলরকে চিনি না। তাঁর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি রাজশাহীতে যোগদান করার কিছুদিন পর ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়। এরপর আমি অফিসটাকে একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। আমি কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। এ ধরনের কোনো কিছুতেই আমার কারো সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘ড্রাইভিং পরীক্ষার বিষয়ে আরো স্বচ্ছতা আনতে আমি বরং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখেছি। কাজেই পরীক্ষা বা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার অভিযোগটি সঠিক না।’ তিনি দাবি করেন, তাঁর অতিরিক্ত সম্পদ নেই।