
১৯৮৩ সালের কথা। কাজের খোঁজে স্থানীয়রা যখন কালাব্রিয়া ছাড়ছেন তখন ২০ বছর বয়সী রোজেল্লা আকুইলান্তি সিদ্ধান্ত নেন তিনি সেখানকার এক জনশূন্য গ্রাম পেনতেদাত্তিলোতেই থাকবেন। এখন তার বয়স ৬৩ বছর।
ইতালির দক্ষিণপশ্চিমে সাগর-ঘেরা নৈস্বর্গিক পাহাড়ি উপদ্বীপ কালাব্রিয়া। এই অঞ্চলের এক সময়ের জীবন্ত গ্রাম পেনতেদাত্তিলো এখন মৃত-ভুতুরে। কালের রেঁদার টানে খসে পড়েছে ঘরের টালি। উজার হয়েছে দরজা-জানালা। খুলে পড়েছে পাথরের গাঁথুনি।
বছর দুয়েক আগে জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা যায়—প্রায় ৪০ বছর ধরে রোজেল্লা একাই লড়াই করে যাচ্ছেন জনমানবহীন গ্রামটি 'বাঁচিয়ে' রাখার জন্য। সেখানে তিনি সৃষ্টি করেছেন নিজের স্বর্গ। ছাগল পুষে চালিয়ে নিচ্ছেন নিজের জীবিকা। আছে জলপাই গাছ আর বুনো সবজির ঝোপ।

বয়সের ভার তাকে পুরোপুরি ক্লান্ত করতে পারেনি। তবুও নিজের খামারের কাজে সহযোগিতার জন্য সঙ্গে নিয়েছেন এক কিশোরকে।
মালি থেকে অবৈধভাবে ইতালি আসা সেই কিশোর মাকা তোউনকারাকে শরণার্থী শিবির থেকে নিজ গ্রামে এনেছেন সরকারি নিয়ম মেনে। দূরের এক শহরে তাকে ভর্তি করিয়েছেন ইতালীয় ভাষা শেখানোর কোর্সে।
রোজেল্লার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেই কিশোরের। কাজ ছাগলগুলোর দেখভাল করা আর মৌসুম এলে গাছ থেকে জলপাই পেড়ে আনা। এর জন্য যে পরিমাণ অর্থ আসে মাকা তা পাঠিয়ে দেয় নিজ দেশে।
এটি শুধু পেনতেদাত্তিলো বা রোজেল্লার গল্প নয়, এটি যেন ইতালির এক বৃহৎ অংশের বর্তমান চিত্র।

গত বছর ১৭ ডিসেম্বর ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক সংবাদ প্রতিবেদনে জানানো হয়—ইতালির জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে শ্রমবাজারে। ইতালিকে ইউরোপের সবচেয়ে বয়সী মানুষের দেশ হিসেবে উল্লেখ করে এতে বলা হয়—২০১৪ সালের পর থেকে সেখানকার জনসংখ্যা ক্রমাগত কমছেই।
প্রতিবেদন অনুসারে, গত দশকে ইতালিতে জনসংখ্যা কমেছে ১৪ লাখ। এই সংখ্যা দেশটির দ্বিতীয় প্রধান শহর মিলানের মোট বাসিন্দার সমান।
ইতালির জনগণের গড় আয়ু ৮৩ বছর। তবে শিশু জন্মের হার যেভাবে কমছে তাতে ২০৫০ সালে সেখানকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগ মানুষের গড় বয়স দাঁড়াবে ৬৫ বছরের বেশি। বর্তমানে দেশটিতে একজন নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার হার এক দশমিক দুই। জনসংখ্যার ভারসাম্য তৈরিতে প্রয়োজন দুই দশমিক এক শতাংশ। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, ইতালিতে সেই লক্ষ্য পূরণ যেন 'সুদূর পরাহত'।
গত ৩১ মার্চ রয়টার্সের এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়, 'ইতালির জনসংখ্যা সংকট আরও খারাপ হয়েছে। জন্মহার সর্বকালের সর্বনিম্ন'। ইতালির জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে ইতালিতে শিশু জন্মের হার আরও কমেছে। অর্থাৎ দেশটির জনসংখ্যা আরও কমেছে। সে বছর সেখানে যত শিশুর জন্ম হয়েছে তার তুলনায় মৃত্যু হয়েছে দুই লাখ ৮১ হাজার বেশি মানুষের।

আগের বছরের তুলনায় গত বছর ইতালির জনসংখ্যা ৩৭ হাজার কমে হয়েছে পাঁচ কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার।
এ দিকে, গত বছরে দেশ ছেড়েছেন প্রায় এক লাখ ৯১ হাজার ইতালীয়। সরকারি হিসাবে, দেশত্যাগের এই হার গত ২৫ বছরে সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে, গত বছর ইতালিতে বিদেশির সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার নয় দশমিক দুই শতাংশ তথা প্রায় ৫৪ লাখ। আগের বছরের তুলনায় তিন দশমিক দুই শতাংশ বেশি। তাদের বেশিরভাগ বাস করেন দেশটির উত্তরাঞ্চলে।
ইতালির অর্থনীতি
গত ৩০ জানুয়ারি রয়টার্স এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলেছিল—ইতালির অর্থনীতিতে স্থবিরতা, ভবিষ্যৎ উন্নতিতে ছায়াপাত। দেশটির গত বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই এমন শিরোনাম দেওয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোজোনের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতালির জিডিপি পরপর দুই প্রান্তিকে কোনো প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেনি। এমন স্থবিরতা দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নতির ওপর ছায়া ফেলছে।

নেদারল্যান্ডের বহুজাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আইএনজি'র জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ পাওলো পিজ্জোলি সংবাদ সংস্থাটিকে বলেন যে, তিনি আশা করেছিলেন এই বছরের শুরুতে ইতালির প্রবৃদ্ধি হবে 'খুবই কম'। দ্বিতীয় প্রন্তিকে 'কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবে'। তার মতে, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক সাত শতাংশ হতে পারে। এটি সরকারের লক্ষ্য এক দশমিক দুই শতাংশের তুলনায় অনেক কম।
গত ২ এপ্রিল ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ব্যবসায়ীরা আশা করছেন চলতি বছর ইতালির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ হতে পারে।
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর স্ট্যাটিস্টার তথ্যে বলা হয়, ২০২৩ সালে ইতালির বেকারত্বের হার ছিল সাত দশমিক ছয় শতাংশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এই হার বা এর কাছাকাছি হার থাকতে পারে।

সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে—ইতালির দক্ষিণাঞ্চলে বেকারত্বের হার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। উত্তরাঞ্চলে তা তিন শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ, দেশটি ভয়ঙ্করভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
সম্প্রতি, ইউরোনিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়—ইতালির অর্থনীতি চাঙা করতে যে শ্রমশক্তির প্রয়োজন তা বিদেশি শ্রমিকদের দিয়ে মেটানো যেতে পারে। কিন্তু, দেশটিতে অভিবাসনবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান সেই সম্ভবনাকে দূরে ঠেলে দিতে পারে।
তাই প্রশ্ন জাগে—ইতালির ভবিষ্যৎ কী?