
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশনে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকরের পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে ইউএস ডলারের দাম। আন্ত ব্যাংক-খোলাবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে নতুন করে আবারও ভয় ধরাচ্ছে এই মুদ্রা। সামনে এই মুদ্রার দর স্থিতিশীল রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। অচিরেই ডলারের দরে আরো পরিবর্তন আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে দীর্ঘদিন ধরে চলা ডলার সংকটে আবারও ভুগবে ব্যবসা-বাণিজ্য। মূল্যস্ফীতিও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, ‘ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর মধ্যস্বত্বভোগীরা আবার সক্রিয় হয়েছে।মজুদ করে রেখেছে রিজার্ভ বাজারে ছাড়ছে না। আমরাও তাদের কাছ থেকে ডলার কিনছি না, দেখা যাক তারা কত দিন ধরে রাখতে পারে।’
তিনি জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার আন্ত ব্যাংকে ১২২ টাকা ৮০ পয়সার মধ্যে ডলার লেনদেন হয়েছে। অন্যদিকে এলসি সেটলমেন্ট হয়েছে ১২৩ থেকে ১২৩ টাকা ৫০ পয়সার মধ্যে। দাম নির্ভর করে গ্রাহকের সক্ষমতার ওপর। যদি গ্রাহক শক্তিশালী বা বড় ক্লায়েন্ট হয় সে ক্ষেত্রে বার্গেনিং করে কম দামে ডলার নিতে পারে। আর যদি দুর্বল গ্রাহক হয় সে ক্ষেত্রে ব্যাংক তার কাছ থেকে ডলারের দাম বেশি রাখে। এর ফলে বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বিপাকে পড়ছেন।
গত বুধবার থেকে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখন চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে এর দাম ওঠানামা করছে। কিছু দুর্বল ব্যাংক বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনছে। ফলে তারা নির্ধারিত দরের বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে ডলারের দাম বেড়েছে। তবে বেশির ভাগ ব্যাংক এখনো ১২২ টাকার মধ্যেই আমদানিতে ডলার বিক্রি করছে।
রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকায় অবস্থিত মানি চেঞ্জারগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, মানি এক্সচেঞ্জগুলোর নোটিশ বোর্ডে প্রতি ডলারের বিক্রয় মূল্য ১২৪ টাকা লেখা থাকলেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু কিছু জায়গায় ডলার পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে ১২৭ টাকায়।
বিক্রেতারা বলেন, ‘অনেক দিন থেকে কেউ ডলার কিনতে ও বিক্রি করতে আসছে না। তাই আমাদের ব্যবসা খুব খারাপ। কিন্তু আড়ালে গিয়ে বেশি দাম দিতে চাইলে ডলার পাওয়া যাচ্ছে। ওই আড়ালের অবৈধ বাজারে ১২৭ টাকা দাম চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, এখন হজে যাওয়ার জন্য খোলাবাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের ওপর ডলারের দাম ছেড়ে দেওয়ায় বাজার একটু গরম।’
গুলশানের লর্ডস মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেডে ইউরো কিনতে আসা তারিকুল ইসলাম জানান, ‘মানি এক্সচেঞ্জে জিজ্ঞেস করলাম, তারা বলল ইউরো নেই। এরপর জানতে চাইলাম, ডলার হবে? বলে ডলারও নেই। তাহলে আমরা কোথায় যাব?’ বশির উদ্দিন নামের আরেক ক্রেতা বলেন, ‘কিছু ডলার নিতে এসেছিলাম; কিন্তু নেই। এখন কী আর করব, অন্যান্য মাধ্যমে চেষ্টা করতে হবে।’
বাংলাদেশ মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম জামান বলেন, ‘আমরা কোনো নির্দেশনা পাচ্ছি না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যদি কিছু জানানো হয় তাহলে ভালো হতো। এরই মধ্যে মানি এক্সচেঞ্জগুলো থেকে ১২৪ থেকে ১২৬ টাকায় ডলার বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাদের সঙ্গে ইলেকট্রনিক বা ভার্চুয়াল মানির কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের কাজ হলো ক্যাশ ডলারের সঙ্গে। আর ব্যাংকের তুলনায় ক্যাশ ডলারের দাম সব সময় এক টাকা বা দুই টাকা বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ডলারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, বেনামি ঋণ, তারল্য সংকট, অব্যবস্থাপনাসহ নানা সমস্যা থাকলেও বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় স্বস্তিতে আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ২০২২ সালের শুরুতে ডলারের দামে যে অস্থিরতা শুরু হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা থেমে গেছে। অর্থপাচার কমে আসায় বৈধ পথে প্রবাস আয় বাড়ছে। এতে রিজার্ভও বাড়ছে। এ ছাড়া আর্থিক হিসাবের ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে পৌঁছেছে, কমে এসেছে চলতি হিসাবের ঘাটতি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘এটা রীতিমতো অন্যায়। এত বেশি দরে ডলার কেনাবেচার কোনো সুযোগ নেই, এ বিষয়টি আমরা দেখছি। যারা এসব কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ব্যাংক থেকে এত বেশি দরে মানি এক্সচেঞ্জে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে, এটা প্রমাণিত হলে মানি এক্সচেঞ্জকে অর্থদণ্ড করা হবে। অভিযোগ গুরুতর হলে লাইসেন্স বাতিল করাও হতে পারে।’
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে দুবাই ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কিছু সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এ জন্য বাজারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
মানি এক্সচেঞ্জ হাউসে ডলার পাঁচ টাকা বেশিতে কেনাবেচার প্রসঙ্গে নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনৈতিক সংকটে ব্যবসায় স্থবিরতা চলছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন করে এলসি খোলার চিন্তাই করা যাচ্ছে না। আমদানির পুরনো বিল পেমেন্টে ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে সবার আগে প্রয়োজন দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। ডলারের দাম নতুন করে অস্থিতিশীল হলে ব্যবসায় ভোগান্তি বাড়বে।’
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সাড়ে ১০ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রায় ২৫ বিলিয়ন বা আড়াই হাজার কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে দেশে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। সেবার প্রবাসীরা পাঠান দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য নিষ্পত্তি সংস্থা এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বকেয়া পরিশোধের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে। অন্যদিকে গ্রস রিজার্ভ রয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপরে।
গত বছরের ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করে। তখন ডলারের ভিত্তিমূল্য ১০ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত হয়, এই দামে ২ শতাংশ বেশি বা কমে ডলার কেনাবেচা করা যাবে। তবে কিছুদিন ১২০ টাকায় বিনিময় হলেও পরে তা বাড়তে বাড়তে ১২৬-১২৭ টাকায় পৌঁছে যায়।
এই ব্যবস্থাকে তুলে দিয়ে বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে বলছে আইএমএফ। বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আইএমএফের পরামর্শ ছিল পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে পারেন। যদি এর ফলে অস্থিরতা বেড়ে যায়, তাহলে আবার ক্রলিং পেগে ফিরে আসা যেতে পারে। তবে এখন পরীক্ষা করে দেখার সময় এসেছে।’
গত নভেম্বরের পর থেকে টানা মূল্যস্ফীতি ১১.৩৮ শতাংশ থেকে কমে এপ্রিলে ৯.১৭ শতাংশে নেমেছে। বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে কি না, জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি ব্যাংকে ডলারের রেট না বাড়ে তাহলে খোলাবাজারে ডলার রেট বাড়লেও তা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে না। আর ব্যাংকে ডলার রেট বাড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আমাদের রেমিট্যান্সপ্রবাহ অনেক ভালো। আবার আমদানিতে ডলারের তেমন সংকট নেই।’
তবে ব্যাংকারদের মতে, এখনো পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়নি। এমটিবি পিএলসির সিইও ও এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যেদিন আমরা দেখব ইন্টারব্যাংক পুরোপুরি অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে এবং বাজার রেমিট্যান্সনির্ভর না হয়ে ইন্টারব্যাংকের ওপর নির্ভর করছে, তখন এই পদ্ধতিতে যাওয়া যৌক্তিক হবে। কিন্তু এখনো মাঝেমধ্যে ডলার সংকট দেখা দেয়, তাই এখনই এটি বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।’
এর আগে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছিল ২০০৩ সালের ৩১ মে। ওই দিন থেকে টাকাকে ‘ভাসমান মুদ্রা’ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ ডলারের মূল্যমান নির্ধারণের দায়িত্ব বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। নতুন এই বিনিময় হার আসলে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক ছিল না, বরং ছিল নিয়ন্ত্রিত বা ‘ম্যানেজড ফ্লোটিং’। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন বা অতি মূল্যায়ন করত। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৮৬ বার অবমূল্যায়ন এবং ছয়বার অতি মূল্যায়ন করেছে।