
পালটাপালটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপথ। বিষয়টি নিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। চারদিকে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের ছায়া পড়েছে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায়। দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সংকটের সম্মানজনক সুরাহা না হলে পদত্যাগ করতে চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টারা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকের পর তারা অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেন। এছাড়া ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার জন্য প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে তিনি এই আহ্বান জানান। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক ছিল। ওই বৈঠকের পর অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় কী তা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের কাছে জানতে চান। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড এবং তাদের দায়-দায়িত্ব নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকের পর একাধিক উপদেষ্টা এসব কথা যুগান্তরের কাছে নিশ্চিত করেন।
জানতে চাইলে এক উপদেষ্টা যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা তার অন্যতম প্রধান কারণ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পালটাপালটি কর্মসূচি। এসব কর্মসূচির কারণে ভয়াবহ আকারে জনদুর্ভোগ হচ্ছে। সরকারের নিয়মিত কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো কোনো দায় নিচ্ছে না। সব দায় সরকারের ওপর চাপাচ্ছেন।’ অপর এক উপদেষ্টা যুগান্তরকে বলেন, ‘রাজপথে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে উপদেষ্টাদের কিছু করণীয় আছে কিনা তা জানাতে বলেন প্রধান উপদেষ্টা। যদি করণীয় কিছু না থাকে সেটাও জানাতে বলেছেন।’
উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠক শেষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সরকারি কর্মকর্তারা সভাস্থল ত্যাগ করেন। এরপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করেন। এই বৈঠক চলে প্রায় চার ঘণ্টা। বৈঠকের এক পর্যায়ে উপদেষ্টাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে আজকেই (বৃহস্পতিবার) পদত্যাগ করব। এই জঞ্জালের দায় আর নিতে চাই না। ইতোমধ্যে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সবকিছুর পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন আছে। একাধিক উপদেষ্টা বৈঠকে একটি দলের কথা উল্লেখ করে বলেন-নির্বাচন কমিশনার, পুলিশ সুপার (এসপি) এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি)সহ প্রশাসনের অধিকাংশ লোকই তাদের। এ অবস্থায় নির্বাচন দিলে তা হবে একটি সাজানো নির্বাচন। এই সাজানো নির্বাচনের দায় আমরা কেন নেব? এরপর জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের স্ক্রিপ্ট লেখা ও তা রেকর্ড করার আয়োজন শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত দু-একজন সিনিয়র উপদেষ্টা আরও দু-একদিন দেখার অনুরোধ করেন। আগামী শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক হওয়ার বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় রাজপথে পৃথক কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও এনসিপি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসাবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ পড়ানোর দাবিতে তার নেতাকর্মীরা আন্দোলন করে আসছেন কয়েকদিন ধরে। তারা সরকারের ছাত্র প্রতিনিধি স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করেন। যদিও বৃহস্পতিবার দুপুরে এ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। এদিকে দুপুরে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করে বিএনপি। অপরদিকে এনসিপি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে বুধবার নির্বাচন কমিশন এবং বৃহস্পতিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। দলটি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে বিএনপিপন্থি আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করার হুঁশিয়ারি দেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ এ বৈঠক করল।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ পৃথক পৃথক ফেসবুক পোস্টে জুলাই ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ঐক্যের আহ্বান জানান। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার আগের বক্তব্যের শব্দ এবং বক্তব্যের যে অংশ বিভাজনমূলক ছিল, সে বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ‘ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড়’ শিরোনামে এক পোস্টে তিনি এ কথা উল্লেখ করেন।
ফেসবুক পোস্টে মাহফুজ আলম লেখেন, ‘দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য। আগেকার যে কোনো বক্তব্য ও শব্দচয়ন, যা বিভাজনমূলক ছিল, সেগুলোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সরকারে আর একদিনও থাকলে অভ্যুত্থানের সব শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা রেখে কাজ করতে চাই।’ তিনি আরও লেখেন, ‘পুরাতন বন্দোবস্তের বিভেদকামী স্লোগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হত্যাযোগ্য করে তোলে, সেগুলো পরিহার করলেই আশা করি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।’
হাসনাত আবদুল্লাহ তার ফেসবুক পোস্টে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি লেখেন, যে বিভাজনটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের মধ্যে এসেছিল, সেই বিভাজনকে দেশ ও জাতির স্বার্থে মিটিয়ে ফেলতে হবে। এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এবং পতিত ফ্যাসিবাদীদের নগ্ন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পর নাহিদ ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ও রাজনৈতিক লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সন্ধ্যা ৭টায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় তাদের সাক্ষাৎকালে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে চান। আলোচনায় নাহিদ ইসলাম এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা, দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে ভেবে দেখার আহ্বান জানান।