
সন্ধ্যায় দৈনিক মানবজমিনের অনলাইনে সংস্করণে প্রচারিত একটি রাজনৈতিক বা সংবাদ ভাষ্য নিয়ে দেশ-বিদেশের আলোচনার ঝড় উঠে। এতে বলা হয়েছে, ‘সর্বশেষ খবর অধ্যাপক ইউনূস (প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস) ইতিমধ্যেই অভ্যুত্থানের (২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট) নায়কদের ডেকে বলেছেন, তোমরা সংযত হও, না হলে আমি পদত্যাগ করব।’
আরো বলা হয়, ‘অধ্যাপক ইউনূস এখন কী করবেন? তার সামনে বিকল্প খুবই কম। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার নেতৃত্ব অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে। হয় তিনি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবেন, না হয় পদত্যাগ করে চলে যাবেন।’
মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে বৃহস্পতিবার বিকেলে ৫টা ৪৭ মিনিটে রাজনৈতিক ভাষ্যটি প্রচারিত হয়। এর শিরোনাম- ‘প্রফেসর ইউনূস এখন কী করবেন’। এটি লিখেছেন শান্তনা রহমান।
এ সংবাদ ভাষ্য এর মধ্যে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ (আলোচিত)। এতে অর্ন্তভুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা চলছে। অনেকে এগুলোর সঙ্গে ‘সহমত’, আবার অনেকে ‘দ্বিমত’ প্রকাশ করছেন। কে এই সাংবাদিক শান্তনা রহমান, এ প্রশ্নও অনেকের।
সময় টিভির যুগ্ম বার্তা সম্পাদক রবিউল ইসলাম নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ প্রসঙ্গে লেখেন, 'দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে শান্তনা রহমান- এ নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। এটি একটি ছদ্মনাম। লেখাটিতে কোনো সোর্স (সূত্র) উল্লেখ করা নেই। দশ শতাংশ তথ্য, দশ শতাংশ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, দশ শতাংশ প্রেডিকশন (ভবিষ্যদ্বাণী) এবং ৭০ শতাংশ গল্প মিলিয়ে সংবাদ ভাষ্যটি হাজির করা হয়েছে।'
খোঁজ নিলে জানা যায়, এটি মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার মতিউর রহমান চৌধুরীর লেখা। প্রাজ্ঞ এ সাংবাদিক প্রায়ই এ ছদ্মনামে লিখে থাকেন। শুধু মানবজমিনেই নয়, 'সাপ্তাহিক জনতার চোখ' পত্রিকায়ও তিনি মূল নাম আড়াল করে ভিন্ন নামে লেখেন।
'জনতার চোখ' মানবজমিনের সহযোগী প্রকাশনা। এটি রাজনৈতিক ম্যাগাজিন। গত ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর থেকে নতুন করে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকাটি। এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। 'জনতার চোখ' আগেও প্রকাশিত হয়েছিল, শেখ হাসিনার গত সরকারের আমলে এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মতিউর রহমান চৌধুরী জনতার চোখে 'ছদ্মনামে' লিখতেন।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতা' কিংবা 'সাংবাদিকতার জন্য মুক্ত পরিবেশ' দেশে নিশ্চিত হয়েছে। সরকারের দিক থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ও সাংবাদিক শফিকুল বলেছেন, 'সাংবাদিকতার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর আসেনি।' তাহলে এখন কেন মতিউর রহমান চৌধুরী ছদ্মনামে লেখেন?
মতিউর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের আমলের সুবিধাভোগী সাংবাদিক, সম্পাদক নন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে প্রশ্ন করার নামে তার প্রশংসা তিনি করেননি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে তিনি নানাভাবে রোষানলে পড়েন ও নির্যাতনের শিকার হন। তাহলে রাজনৈতিক পালাবদলের পর দেশের সাংবাদিকতায় ভয়ের পরিবেশ কী কাটেনি?
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, গণমাধ্যমে এখনো ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আছে। অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যের শুরুতে বলেন, তিনি কী ভয়ে ভয়ে বলবেন, নাকি নির্ভয়ে বলবেন। কারণ, তিনি ‘ছায়া’কে ভয় পাচ্ছেন। আর সংস্কার শুনলেও ভয় লাগে। ১৯৭৫ সালে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আবারও সে ধরনের কিছু ঘটে কী না, তা নিয়ে তিনি ভীত।
ঢাকার কারওয়ানবাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই করার ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘পত্রিকা কার্যালয়ের সামনে গরু জবাই হয়, এ দেশে আমরা বাস করি, কী সাংবাদিকতা করব?’
নিজের সাংবাদিকতা–জীবনে মামলা, হামলা ও কারাভোগের কথা তুলে ধরে তিনি ওই অনুষ্ঠানে বলেন, কোনো সরকারের আমলেই তিনি ভালো ছিলেন না। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মন খুলে লিখতে বলেছেন। এটা আশার কথা। কিন্তু সাংবাদিকরা কী লিখতে পারছেন—এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপ থেকে বের হতে পারছেন না। এখান থেকে বের হতে না পারলে যাত্রাটা কঠিন হবে।
এসব বিষয়ে বৃহস্পতিবার রাতে চেষ্টা করেও মতিউর রহমান চৌধুরীর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। মানবজমিনের শীর্ষ দায়িত্বে থাকা এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুখবর ডটকমকে বলেন, প্রতিষ্ঠান ও নিজের সহকর্মীরা মবোক্রেসির আক্রমণের শিকার যেন না হন, সেই 'সতর্কতা' থেকে মতিউর রহমান চৌধুরী ছদ্মনামে লেখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন, 'দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অটোক্রেসির হাত থেকে এসে মবোক্রেসির দৌরাত্ম্যে পড়েছে। আগে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করত, এখন মব তৈরি করে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। মবের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো হচ্ছে। সরকার সেটি দেখেও না দেখার ভান করছে।'