Image description

চব্বিশের বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতনই ঘটায়নি, বরং ভেঙে দিয়েছে বিভ্রান্তির আবরণ, মুছে দিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র-সমর্থিত প্রপাগান্ডার ছায়া, এবং সূচনা করেছে এক নতুন রাজনৈতিক বোধের। এই নতুন বাংলাদেশে আর কেউ রাজাকার নয়, পাকিস্তানপন্থি নয়; বরং এখনো টিকে আছে একদল ভারতপন্থি, যাদের ভূমিকা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে নয়, বরং ভারতের আধিপত্যবাদী স্বার্থের প্রতিক।

স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষাকারী কারা?
যাদের ৭১-এর বিরোধিতার অজুহাতে আজও ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ বলা হয়—যেমন জামায়াতে ইসলামী বা শিবিরের নেতা-কর্মীরা—তাঁরা বাস্তবে স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রু ছিলেন না। গত পাঁচ দশকের ইতিহাস প্রমাণ করে, তাঁরা বাংলাদেশের স্বার্থেই রাজনীতি করেছেন, আন্দোলন করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, জীবন দিয়েছেন। অন্যদিকে, যারা ভারতের আগ্রাসন ও আধিপত্যের পক্ষে অবস্থান নেয়, তারাই প্রকৃত স্বাধীনতা বিরোধী। একবিংশ শতকের বাংলাদেশে সত্য-মিথ্যার এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে সত্যকে সামনে আনা এখন সময়ের দাবি।

যুদ্ধাপরাধ: ঐতিহাসিক সত্য বনাম রাজনৈতিক অপব্যবহার:
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু দীর্ঘদিন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে—১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ করেছিল মূলত পাকিস্তানি সেনারা। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালেই ৩৭,৪৭১টি মামলা দায়ের করে, যার মধ্যে বিচার হয় ২,৮৮৪টির এবং সাজা হয় ৭৫২ জনের। শেখ মুজিব নিজেই ৩৬,৪০০ অভিযুক্তকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই তালিকায় কোনো শীর্ষ জামায়াত নেতার নাম ছিল না—তথ্যপ্রমাণ তা-ই বলে।

শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভূমিকা:
যদি যুদ্ধাপরাধের বিচারই হয় মূল লক্ষ্য, তাহলে প্রথমেই শেখ মুজিবকে ঐতিহাসিক বিচারের আওতায় আনতে হবে। কারণ তিনি শিমলা চুক্তির মাধ্যমে ১৯৩ জন চিহ্নিত পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে পাঠিয়েছিলেন। তিনি জাতিকে বলেছিলেন, “বাঙালি ক্ষমা করতে জানে”—এই বক্তব্যে গৌরব থাকলেও, ইতিহাসের ন্যায়বিচার কি এতে হয়েছে?

বিহারিদের হত্যাকাণ্ড: অবিচারের আরেক দৃষ্টান্ত:
৭১-পরবর্তী সময়ে হাজার হাজার বিহারি নাগরিককে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তারা কি যুদ্ধাপরাধী নয়? এই জাতিগত নির্মূল অভিযান আজও বিচারহীনতা ও পক্ষপাতমূলক ন্যায়বিচারের বড় প্রমাণ। নতুন বাংলাদেশে এই অপরাধীদেরও বিচার দাবি করে।

ক্যাংগারু কোর্ট ও জেনোসাইড অফ জাস্টিস:
যারা কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে বিরোধী নেতাদের যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে তথাকথিত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করেছে—লন্ডনের সুপ্রিম কোর্ট যার নাম দিয়েছে “Genocide of Justice”—তাদেরও বিচার ও ভিক্টিম পরিবারের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এখন অনিবার্য। এদের অনেকেই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করে রাজনৈতিক আদালতের নামে নিপীড়ন চালিয়েছে।

ট্যাগিংয়ের রাজনীতি ও সামাজিক হত্যাকাণ্ড:
যারা “রাজাকার”, “যুদ্ধাপরাধী”, “স্বাধীনতা বিরোধী” ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে নিরীহ মানুষকে সামাজিকভাবে হত্যা করেছে, নিপীড়িত করেছে, তাদের প্রতিও রাষ্ট্রকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সত্যের মুখোশ খুলে তাদের অপরাধ তুলে ধরতে হবে।

নতুন ট্যাগিং, নতুন ফ্যাসিবাদ:
এখনো যারা চব্বিশের বাংলাদেশে “নতুন রাজাকার”, “নতুন যুদ্ধাপরাধী” বলে রাজনীতি করছে—তারা মূলত ফ্যাসিবাদী রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটাতে চায়। এসব অপপ্রচার, ট্যাগিং ও বিভাজনের রাজনীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে। তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

উপসংহার:
চব্বিশের বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশ সত্য, ন্যায়বিচার এবং সার্বভৌমত্বের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এখানে আর কোনো রাজনৈতিক অপপ্রচার, ঐতিহাসিক বিকৃতি, বা ট্যাগিংয়ের রাজনীতি চলবে না। এ দেশ এখন আত্মপরিচয়ে উজ্জ্বল, গর্বিত এক নতুন বাংলাদেশের পথে। এবং এই পথ হবে ঐতিহাসিক সত্য, নৈতিক সাহস ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ডঃ  মুহাম্মদ সাইদুল ইসলাম