
দেড় লক্ষাধিক দখলদারের কবজায় আড়াই লাখ একরের বেশি বনভূমি; যার আনুমানিক বাজারমূল্য ১২ লাখ কোটি টাকা। সংরক্ষিত বনভূমিই জবরদখল হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার একরের বেশি। অন্যান্য ভূমি দখল হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার একরের মতো। বনের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে রিসোর্ট, কটেজ, ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা, দোকানপাট, গবাদি পশুর খামারসহ নানান স্থাপনা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলেও রয়েছে বনের অনেক জায়গা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বনভূমি উদ্ধারে জোর পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া জমি ফেরত আনা হচ্ছে। বনভূমি উদ্ধার কার্যক্রম জোরদারে গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। গত নয় মাসে উদ্ধারের পরিমাণ ১ শতাংশের কম।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দখলদারদের পেছনের শক্তি অনেক বেশি। আমাদের যে লজিস্টিক সাপোর্ট আছে, তা নিয়ে রাতারাতি এত জমি উদ্ধার সম্ভব না। অনেক স্থানে বনভূমি দখল করে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। তিন পুরুষ ধরে বনের জমি ভোগদখল করছে। এসব জমি নিয়ে অনেক মামলা রয়েছে। আদালতের স্থগিতাদেশ আছে। উচ্ছেদে যেতে পারছি না। গাজীপুরের বেদখল ৮৮ একর বনভূমি থেকে ৫০ একর উদ্ধার করতেই নয় মাস লেগে গেছে। তাই আমরা নতুন দখল উচ্ছেদ করছি। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া বনের জমি ফেরত আনছি।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার সীমিত সময় বিবেচনায় কয়েকটি কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করছে। বিভিন্ন সংস্থার জন্য বরাদ্দ করা কক্সবাজারের প্রায় ১২ হাজার একর বনভূমি বন বিভাগের কাছে ফেরত দেওয়া হচ্ছে। আমার লক্ষ্য অন্তত ২০ হাজার একর বনভূমি উদ্ধার করা ও ১০ হাজার একর উদ্ধারের পথ তৈরি করে দিয়ে যাওয়া।’ বন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে জবরদখল করা বনভূমির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর। জবরদখলে রয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে স্থায়ী স্থাপনাসহ কলকারখানার দখলে ১ হাজার ৭২২ একর। হাটবাজার, দোকানপাট, রিসোর্ট/কটেজ, কৃষি ফার্ম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে ১৩ হাজার ৪৩৫ একর; ব্যক্তিমালিকানাধীন ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে ১ লাখ ৮ হাজার ৪৫৮ একরে এবং স্থায়ী স্থাপনাবিহীন (কৃষিজমি, চারণভূমি, বাগান, লবণ চাষ, পতিত ভূমি ইত্যাদি) ব্যক্তিমালিকানাধীন দখলে আছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪৩ একর। এসব বনভূমি উদ্ধারে বন বিভাগের দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৮ হাজার ৬০৬টি। অনেক মামলা যুগ যুগ ধরে চলছে। সূত্র জানান, মামলাগুলো দ্রুত এগিয়ে নিতে বন বিভাগেরই আগ্রহ কম। কারণ অধিকাংশ জমি বেদখল হওয়ার পেছনে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের হাত রয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, সরকার গত বছরের আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৭১৬ দশমিক ৯৮ একর জবরদখল করা বনভূমি উদ্ধার করতে পেরেছে, যার অধিকাংশ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। এ ছাড়া কক্সবাজারে লোকপ্রশাসন একাডেমি স্থাপনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৭০০ একর সংরক্ষিত বনভূমির বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। কক্সবাজারে ফুটবল ফেডারেশনের জন্য ২০ একর সংরক্ষিত বনভূমি অবমুক্তকরণবিষয়ক প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অনুকূলে সোনাদিয়া দ্বীপে বরাদ্দ দেওয়া জমি বন বিভাগের অনুকূলে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কক্সবাজারে শহীদ এ টি এম জাফর আলম ক্যাডেট কলেজের (বেসরকারি) অনুকূলে ১৫৫.৭০ একর বনভূমি বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়েছে। মিরসরাই রেঞ্জে বেজার অনুকূলে বন্দোবস্ত দেওয়া ২২ হাজার ৩৩৫ একর বনভূমির মধ্যে গাছপালা বিদ্যমান ৪ হাজার ১০৪ একর ফেরতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন দখলের খবর পেয়ে ২৬ এপ্রিল গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সাতখামাইর বিটে যৌথ বাহিনীর অভিযানে সদ্যনির্মিত ৫৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের ৪ একর বনভূমি উদ্ধার করা হয়। ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, বাংলাদেশের সব স্থানে জমির দাম এক নয়। কোথাও বেশি, কোথাও কম। সম্প্রতি গাজীপুরে ৪ একর বনভূমি উদ্ধার করা হয়েছে; যার মূল্য ২০ কোটি টাকা বলে গণমাধ্যমে এসেছে। এ হিসেবে ১০ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার বনভূমি জবরদখলে আছে। দাম মুখ্য ব্যাপার নয়, বনভূমি উদ্ধারটা বড় কথা। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলেই বনের প্রচুর জমি রয়েছে। আগে সেগুলোই উদ্ধার করুক না, সেটা হলে বাকিগুলোও করা যাবে।