Image description
গাজীপুরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে অব্যবস্থাপনা ও রোগীদের প্রতি অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, এখানে সেবা থেকে ভোগান্তি বেশি। চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসক-নার্স, নেই পর্যাপ্ত পরিবেশগত নিরাপত্তা-সবমিলিয়ে হাসপাতালের এমন করুণ চিত্র ফুটে উঠে। 
 
সম্প্রতি গাজীপুরের বাসিন্দা সুজন আহমেদ তার শিশু সন্তানের চিকিৎসা জন্য নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ইমারজেন্সি বিভাগ থেকে ৯ তলায় পাঠানো হয়, সেখান থেকে ৮ তলায়-কিন্তু কোথাও ছিলেন না দায়িত্বে থাকা কোনো চিকিৎসক। সন্তানের চিকিৎসা না পেয়ে হতাশ সুজন ফেসবুক লাইভে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তান আশঙ্কাজনক, আমি ডাক্তার খুঁজে পাচ্ছি না। এখন যাবো কোথায়?’ এ ঘটনায় সবার বিবেককে নাড়িয়ে দেয়।
 
গত ১৪ মে হাসপাতালে ভর্তি হন শংকর চন্দ্র সূত্রধর (৫১)। হার্টের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তাকে দেওয়া হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, যার ফলে তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি এখন নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারছি না। ডাক্তার-নার্সদের যত্ন পাচ্ছি না। ১৩ মে মারাত্মক আহত অবস্থায় ভর্তি হওয়া অমূল্য বিশ্বাস (৫৫) আজও ফ্লোরেই পড়ে আছেন। 
 
তার ভাতিজা জানান, ফ্লোরে ধুলাবালির মধ্যে আমার চাচা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার রোগী তানভীর আহমেদ (২২) বাইরের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্লাস্টারের জন্য দিতে হয়েছে ১৫০০ টাকা, কোনো রসিদ ছাড়াই।
 
বিভিন্ন রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন, আল্টাসনোগ্রাম, সিটি স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে। হাসপাতালের স্টকে প্রয়োজনীয় ওষুধ না থাকায় রোগীদের বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে তা কিনে আনতে হচ্ছে, যা অর্থনৈতিকভাবে তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, করিডোরে ময়লার স্তূপ, সিঁড়ির পাশে মেঝেতে কুকুর ঘুমিয়ে আছে, টয়লেট ব্যবহার অযোগ্য। হাসপাতালের পরিবেশ খুবই অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, কিছুদিন আগে লিফটে আটকে গিয়ে এক রোগী প্রাণ হারিয়েছেন, যার জবাবদিহি আজও হয়নি। বিভিন্ন রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন, বেড পেতে ওয়ার্ডবয় ও কর্মচারীদের দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা, এমনকি ট্রলি ব্যবহারেও গুনতে হয় অর্থ। হাসপাতালের কিছু কর্মচারী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছে।

 
সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, জুলাই মাসে ডাক্তারদের রদবদলের কারণে এই অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়েছে। এখন তা অনেকটাই স্বাভাবিক। পেডিয়াট্রিক, নাক-কান-গলা ও অর্থোপেডিক রোগীরা এখন আট তলায়। ইমার্জেন্সিতে অবহেলার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। ওষুধের ঘাটতি আংশিক রয়েছে, যেগুলো নেই, তা রোগীদের বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে।
 
তিনি আরো জানান, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আউটসোর্সিং লোক আমরা ঠিকাদারের মাধ্যমে নিয়ে থাকি। ঠিকাদার এখানে ৫ পার্সেন্ট কমিশন পায়। সব বিষয়ে আরো নজরদারি বাড়ানো হবে। নষ্ট লিফটি দ্রুত সারানোর ব্যবস্থা করা হবে। চলমান লিফটগুলো আরো আধুনিক করা হবে। 
 
তিনি বলেন, হার্টের রোগীর যদি ইনফেকশন থাকে, তাহলে ওই রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যায়। রোগী না বুঝে হয়তো ভুল চিকিৎসার কথা বলছেন। রোগীদের অবহেলা, সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না, এটা আসলে পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ ডাক্তার এবং নার্সের সঙ্কট আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। বর্তমানে আমার এখানে সিটি স্ক্যান, আল্টাসনোগ্রাম, এক্সরে, অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মেশিনারিজ সচল রয়েছে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেটা এখানে নেই সেটা রোগীদের বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে। প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ধুলোবালিতে হাসপাতাল অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। আমরা সেটা প্রতিদিন পরিষ্কার করছি। স্বজনপ্রীতি ও লবিংয়ের মাধ্যমে ঠিকাদাররা কাজ পেয়ে থাকেন কিনা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা কাজ দিয়ে থাকি।
 
গাজীপুরবাসী ও স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি চিকিৎসক ও নার্সদের উপস্থিতি ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি সংযোজন করতে হবে। ওষুধের সরবরাহ বাড়ানো ও ফার্মেসির উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও খাবারের মান নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও স্বচ্ছ প্রশাসন গঠন করতে হবে। ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
 
আজকালের খবর