
ভারত গত এপ্রিল মাসের শুরুতে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে দেয়। এরপর স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। এর এক মাসের মাথায় এবার ভারতও বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বেশ কিছু পণ্য এখন আর ভারতের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
রফতানিকারকদের আশঙ্কা, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। কারণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে— আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পোশাক ও ভোগ্যপণ্য রফতানি করে আসছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য ভারতের বাজার সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা করছেন তারা।
নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দু’দেশের পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে ভারত তার সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের (সিবিআইসি) নির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনও দেশে রফতানির ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। এরপর ৯ এপ্রিল বাংলাদেশও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ভারত শনিবার (১৭ মে) নতুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানায়, এখন থেকে শুধু কলকাতা ও নবসেবা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেই বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এর বাইরেও বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ফলমূল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিকসামগ্রী, সুতা ও আসবাবপত্র আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কেন ভারতীয় ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাকে আগ্রহী?
বিজিএমইএর কর্মকর্তারা বলছেন, গুণগত মান, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ও সময়মতো পণ্য সরবরাহের কারণে ভারতীয় ক্রেতারা বাংলাদেশি পোশাকের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ভারতীয় বাজারে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে সঠিক বিপণন কৌশল এবং সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা। তবে হঠাৎ করে এসব স্থলবন্দর বন্ধ হওয়ায় রফতানি কার্যক্রমে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সমুদ্রপথে রফতানিতে সময় ও খরচ বাড়ায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করছেন রফতানিকারকরা।
ভারতে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ১৮.৮৫ শতাংশ
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় বাজারে মোট রফতানি আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৩৮ লাখ ১০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ আয় প্রায় ৯ কোটি ডলার বেশি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ যে পরিসংখ্যান সংকলন করেছে, তাতে দেখা গেছে— অপ্রচলিত বাজার হিসেবে চিহ্নিত ১৫টি দেশের মধ্যে ভারত অন্যতম প্রবৃদ্ধিশীল গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববাজারে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৬৪ কোটি ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। এর মধ্যে অপ্রচলিত বাজারে রফতানি হয়েছে ৫৪৭ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য।
ভারতের পাশাপাশি চীনেও পোশাক রফতানিতে সামান্য প্রবৃদ্ধি (২ দশমিক ৮২ শতাংশ) হলেও ভারতীয় বাজারের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশি পোশাকের গুণগত মান, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য এবং সময়মতো ডেলিভারির কারণে ভারতীয় ক্রেতারা আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
এবার ভারতের বাজারে ধাক্কা খাবে বাংলাদেশি পোশাক
ভারতের নতুন নির্দেশনায় নতুন করে ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো। শনিবার ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানায়, স্থলপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করা যাবে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য এখন থেকে দেশটির বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
শনিবার (১৭ মে) ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, এখন থেকে বাংলাদেশি পণ্য শুধুমাত্র কলকাতা ও নব সেবা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আমদানি করা যাবে। ফলে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো যেমন- ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও মিজোরামে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়বে। তবে এ নিষেধাজ্ঞা নেপাল ও ভুটানের উদ্দেশে ভারতের ট্রানজিট ব্যবহার করে যে পণ্য পাঠানো হয়, তার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।
বাংলাদেশের রফতানিকারকদের আশঙ্কা, ভারতের এই সিদ্ধান্ত দেশের পোশাক খাতসহ মোট রফতানি প্রবাহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রসঙ্গত, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, খাদ্যদ্রব্য ও দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে চলেছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে উত্তেজনা
বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যে ভারতের কড়াকড়ি আরোপের ঘটনায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, ভারতের মূল ভূখণ্ড ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশে একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফলের রস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য ও তৈরি পোশাক— এসব নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমাদের রফতানিকারকরা।’
তিনি বলেন,‘স্থলপথে এ ধরনের হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা বাণিজ্যের খরচ ও অনিশ্চয়তা বাড়ায়, যা বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। সেখানে প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ায় সীমান্তবর্তী বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন,‘বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানিতে এখন দূরবর্তী সমুদ্রবন্দর নির্ভর করতে হবে, যা ব্যয় ও সময় বাড়াবে। এতে বহু বছরের গড়ে ওঠা সরবরাহ শৃঙ্খলা চাপে পড়বে।’
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতার চেতনায় এসব অশুল্ক বাধা পুনর্বিবেচনা করা হবে। গঠনমূলক সংলাপ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাণিজ্য সহজীকরণ সম্ভব।’
বিপাকে রফতানিকারকরা
ভারত সরকার বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, হঠাৎ করে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে ভারতমুখী রফতানি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়বে।
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানিতে ভারতের অন্যতম প্রধান গন্তব্য প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারতের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রফতানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রাণ গ্রুপ মূলত স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য পাঠায়। নিষেধাজ্ঞার কারণে রফতানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, সমুদ্র কিংবা আকাশপথে রফতানি অনেক বেশি ব্যয়বহুল।’
তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘হঠকারী এ সিদ্ধান্তের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবনতি ঘটবে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এমন পাল্টাপাল্টি বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হবে।’
তিনি জানান, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক ভারতে রফতানি করা হয়। কিন্তু নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে এই রপ্তাফতানিতে সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়বে। এতে করে ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হতে পারে।
রুবেল আরও বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বড় পোশাক ক্রেতা এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি ভালোই ছিল। এ নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুটান বা নেপালের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভারতের এ নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান
এদিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরদিন রবিবার (১৮ মে) বেনাপোল স্থলবন্দরে আটকে গেছে তৈরি পোশাকবোঝাই ৩৬টি ট্রাক। ঢাকার মৌসুমী গার্মেন্টস ও স্কয়ার ফ্যাশনের চালানসহ এসব পণ্য রফতানির অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে বুড়িমারী সীমান্তে আটকে গেলো প্রাণের ১৭ ট্রাক খাদ্যপণ্য। এসব ট্রাকবোঝাই পণ্য রবিবার সকালে বুড়িমারী সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল।
জানা গেছে, আদেশ জারির পর থেকেই রবিবার থেকে এসব পণ্যের রফতানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে বাংলাদেশের রফতানিকারকেরা চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রফতানিকারক ও বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে টেকসই রাখতে হলে অবিলম্বে কূটনৈতিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, বিকল্প রুট যেমন- সমুদ্র বা আকাশপথ ব্যবহার করতে হলে রফতানিকারকদের বাড়তি খরচ ও জটিলতা মোকাবিলা করতে হবে। ফলে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য সংযোগ পুনঃস্থাপনে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বাণিজ্যিক বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন যেন বাজার ও শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। ভারতীয় বাজারে প্রবেশাধিকার হারানো মানে শুধু পোশাক খাত নয়, সামগ্রিক রফতানি ব্যবস্থার জন্যও একটি বড় ধাক্কা।
বাণিজ্যে বড় ঘাটতি
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ব্যাপক ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী) বাংলাদেশ ভারত থেকে ৯০০০.১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও রফতানি হয়েছে মাত্র ১৫৬৯.২৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪৩০.৯১ মিলিয়ন ডলার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১,৬৯৮.৫ মিলিয়ন ডলার, যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। এরপর কিছুটা ঘাটতি কমলেও সামগ্রিকভাবে ভারসাম্যহীনতা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প— বিশেষ করে নিট ও ওভেন পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের বাজার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ খাতেও সম্প্রতি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে নিট ও ওভেন মিলিয়ে মোট ৭১৫.৪১ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল, সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৪৮.৮৩ মিলিয়ন ডলারে, যা ১৯.৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। এর আগে, ২০২২-২৩ অর্থবছরেও পোশাক রফতানি কমেছিল ৪.৪৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে তৈরি পোশাক, যার পরিমাণ ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার। তবে এই পোশাকের একটি বড় অংশই গেছে স্থলপথে। ভারতের হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞা পোশাক খাতের পাশাপাশি কৃষিপণ্য ও প্লাস্টিক শিল্পেও বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পারে।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য, ৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের তুলা ও সুতার উপজাত এবং ৬৫ লাখ ডলারের আসবাব। এসব পণ্যের বড় অংশই যায় স্থলবন্দর হয়ে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের সদ্য ঘোষিত আমদানি নিষেধাজ্ঞা ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের রফতানি খাতে আরও চাপ বাড়বে। বিশেষ করে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বিকল্প রুট ও পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেবে। এরই মধ্যে রফতানিকারকেরা বিকল্প বন্দরের খোঁজে রয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ভারত গত এপ্রিল মাসের শুরুতে হঠাৎ করেই বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে দেয়। এরপর স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। এর এক মাসের মাথায় এবার ভারতও বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বেশ কিছু পণ্য এখন আর ভারতের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
রফতানিকারকদের আশঙ্কা, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে। কারণ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে— আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পোশাক ও ভোগ্যপণ্য রফতানি করে আসছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য ভারতের বাজার সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা করছেন তারা।
নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দু’দেশের পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে ভারত তার সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের (সিবিআইসি) নির্দেশনার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনও দেশে রফতানির ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে। এরপর ৯ এপ্রিল বাংলাদেশও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করে দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ভারত শনিবার (১৭ মে) নতুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানায়, এখন থেকে শুধু কলকাতা ও নবসেবা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেই বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এর বাইরেও বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ফলমূল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিকসামগ্রী, সুতা ও আসবাবপত্র আমদানিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কেন ভারতীয় ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাকে আগ্রহী?
বিজিএমইএর কর্মকর্তারা বলছেন, গুণগত মান, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ও সময়মতো পণ্য সরবরাহের কারণে ভারতীয় ক্রেতারা বাংলাদেশি পোশাকের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ভারতীয় বাজারে উচ্চ প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে সঠিক বিপণন কৌশল এবং সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা। তবে হঠাৎ করে এসব স্থলবন্দর বন্ধ হওয়ায় রফতানি কার্যক্রমে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সমুদ্রপথে রফতানিতে সময় ও খরচ বাড়ায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করছেন রফতানিকারকরা।
ভারতে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ১৮.৮৫ শতাংশ
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ভারতীয় বাজারে মোট রফতানি আয় হয়েছে ৫৬ কোটি ৩৮ লাখ ১০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এ আয় প্রায় ৯ কোটি ডলার বেশি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ যে পরিসংখ্যান সংকলন করেছে, তাতে দেখা গেছে— অপ্রচলিত বাজার হিসেবে চিহ্নিত ১৫টি দেশের মধ্যে ভারত অন্যতম প্রবৃদ্ধিশীল গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববাজারে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৬৪ কোটি ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। এর মধ্যে অপ্রচলিত বাজারে রফতানি হয়েছে ৫৪৭ কোটি ৮৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য।
ভারতের পাশাপাশি চীনেও পোশাক রফতানিতে সামান্য প্রবৃদ্ধি (২ দশমিক ৮২ শতাংশ) হলেও ভারতীয় বাজারের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশি পোশাকের গুণগত মান, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য এবং সময়মতো ডেলিভারির কারণে ভারতীয় ক্রেতারা আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
এবার ভারতের বাজারে ধাক্কা খাবে বাংলাদেশি পোশাক
ভারতের নতুন নির্দেশনায় নতুন করে ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো। শনিবার ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানায়, স্থলপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করা যাবে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য এখন থেকে দেশটির বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
শনিবার (১৭ মে) ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, এখন থেকে বাংলাদেশি পণ্য শুধুমাত্র কলকাতা ও নব সেবা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে আমদানি করা যাবে। ফলে সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো যেমন- ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও মিজোরামে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়বে। তবে এ নিষেধাজ্ঞা নেপাল ও ভুটানের উদ্দেশে ভারতের ট্রানজিট ব্যবহার করে যে পণ্য পাঠানো হয়, তার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না।
বাংলাদেশের রফতানিকারকদের আশঙ্কা, ভারতের এই সিদ্ধান্ত দেশের পোশাক খাতসহ মোট রফতানি প্রবাহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রসঙ্গত, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, খাদ্যদ্রব্য ও দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে চলেছে।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে উত্তেজনা
বাংলাদেশ থেকে পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যে ভারতের কড়াকড়ি আরোপের ঘটনায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, ভারতের মূল ভূখণ্ড ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশে একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ফলের রস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য ও তৈরি পোশাক— এসব নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমাদের রফতানিকারকরা।’
তিনি বলেন,‘স্থলপথে এ ধরনের হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা বাণিজ্যের খরচ ও অনিশ্চয়তা বাড়ায়, যা বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। সেখানে প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ায় সীমান্তবর্তী বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন,‘বিশেষ করে তৈরি পোশাক রফতানিতে এখন দূরবর্তী সমুদ্রবন্দর নির্ভর করতে হবে, যা ব্যয় ও সময় বাড়াবে। এতে বহু বছরের গড়ে ওঠা সরবরাহ শৃঙ্খলা চাপে পড়বে।’
তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতার চেতনায় এসব অশুল্ক বাধা পুনর্বিবেচনা করা হবে। গঠনমূলক সংলাপ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাণিজ্য সহজীকরণ সম্ভব।’
বিপাকে রফতানিকারকরা
ভারত সরকার বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, হঠাৎ করে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে ভারতমুখী রফতানি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়বে।
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রফতানিতে ভারতের অন্যতম প্রধান গন্তব্য প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারতের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রফতানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রাণ গ্রুপ মূলত স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য পাঠায়। নিষেধাজ্ঞার কারণে রফতানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, সমুদ্র কিংবা আকাশপথে রফতানি অনেক বেশি ব্যয়বহুল।’
তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘হঠকারী এ সিদ্ধান্তের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কে কিছুটা হলেও অবনতি ঘটবে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এমন পাল্টাপাল্টি বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হবে।’
তিনি জানান, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক ভারতে রফতানি করা হয়। কিন্তু নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে এই রপ্তাফতানিতে সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়বে। এতে করে ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল হতে পারে।
রুবেল আরও বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বড় পোশাক ক্রেতা এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি ভালোই ছিল। এ নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুটান বা নেপালের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভারতের এ নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান
এদিকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরদিন রবিবার (১৮ মে) বেনাপোল স্থলবন্দরে আটকে গেছে তৈরি পোশাকবোঝাই ৩৬টি ট্রাক। ঢাকার মৌসুমী গার্মেন্টস ও স্কয়ার ফ্যাশনের চালানসহ এসব পণ্য রফতানির অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে বুড়িমারী সীমান্তে আটকে গেলো প্রাণের ১৭ ট্রাক খাদ্যপণ্য। এসব ট্রাকবোঝাই পণ্য রবিবার সকালে বুড়িমারী সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা ছিল।
জানা গেছে, আদেশ জারির পর থেকেই রবিবার থেকে এসব পণ্যের রফতানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে বাংলাদেশের রফতানিকারকেরা চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রফতানিকারক ও বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ককে টেকসই রাখতে হলে অবিলম্বে কূটনৈতিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, বিকল্প রুট যেমন- সমুদ্র বা আকাশপথ ব্যবহার করতে হলে রফতানিকারকদের বাড়তি খরচ ও জটিলতা মোকাবিলা করতে হবে। ফলে নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য সংযোগ পুনঃস্থাপনে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বাণিজ্যিক বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন যেন বাজার ও শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। ভারতীয় বাজারে প্রবেশাধিকার হারানো মানে শুধু পোশাক খাত নয়, সামগ্রিক রফতানি ব্যবস্থার জন্যও একটি বড় ধাক্কা।
বাণিজ্যে বড় ঘাটতি
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ব্যাপক ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী) বাংলাদেশ ভারত থেকে ৯০০০.১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও রফতানি হয়েছে মাত্র ১৫৬৯.২৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪৩০.৯১ মিলিয়ন ডলার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১১,৬৯৮.৫ মিলিয়ন ডলার, যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। এরপর কিছুটা ঘাটতি কমলেও সামগ্রিকভাবে ভারসাম্যহীনতা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প— বিশেষ করে নিট ও ওভেন পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের বাজার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ খাতেও সম্প্রতি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে নিট ও ওভেন মিলিয়ে মোট ৭১৫.৪১ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল, সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৪৮.৮৩ মিলিয়ন ডলারে, যা ১৯.৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। এর আগে, ২০২২-২৩ অর্থবছরেও পোশাক রফতানি কমেছিল ৪.৪৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে তৈরি পোশাক, যার পরিমাণ ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার। তবে এই পোশাকের একটি বড় অংশই গেছে স্থলপথে। ভারতের হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞা পোশাক খাতের পাশাপাশি কৃষিপণ্য ও প্লাস্টিক শিল্পেও বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পারে।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য, ৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের তুলা ও সুতার উপজাত এবং ৬৫ লাখ ডলারের আসবাব। এসব পণ্যের বড় অংশই যায় স্থলবন্দর হয়ে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের সদ্য ঘোষিত আমদানি নিষেধাজ্ঞা ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের রফতানি খাতে আরও চাপ বাড়বে। বিশেষ করে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বিকল্প রুট ও পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেবে। এরই মধ্যে রফতানিকারকেরা বিকল্প বন্দরের খোঁজে রয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।