
কিছুদিন শান্ত থাকলেও আবারো একের পর এক ছিনতাই, খুন, অস্ত্রের মহড়ায় অস্থির হয়ে উঠেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর। বাসায় ঢুকে একই পরিবারের ৭ জনকে কুপিয়ে জখম, ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে মৃত্যু ও ডাকাত সন্দেহে একজনকে পিটিয়ে হত্যার পর আতঙ্ক বিরাজ করছে পুরো এলাকায়। স্থানীয়রা বলছেন- যৌথবাহিনীর অভিযানে দুই ছিনতাইকারী নিহতের পর স্বস্তি ফিরে এলেও এখন আবারো বিভিন্ন নামে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে একাধিক কিশোর গ্যাং। তাই পুলিশি অভিযানে কেউ কেউ আটক হলেও দমানো যাচ্ছে না তাদের।
গত শুক্রবার রাতে মোহাম্মদপুরের দুর্গা মন্দির গলি এলাকায় মো. নূর ইসলাম (২৬) নামে এক যুবককে সকলের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে। নিহত নূর ইসলাম বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার পূর্বসুজন কাঠি গ্রামের আবুল ফকিরের ছেলে। বর্তমানে শংকর এলাকায় থাকতেন। নিহতের বড় ভাই ওসমান গনি বলেন, আমার ভাই শুক্রবার রাত ৮টার দিকে দুর্গা মন্দির গলিতে দাঁড়িয়ে ছিল। এ সময় দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথা ও দুই হাতে কুপিয়ে জখম করে তার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। পরে আমরা খবর পেয়ে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ওইখানে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনার একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, নিহত নূর হোসেন দুর্গা মন্দির দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল কিশোর তার পথরোধ করে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। দৌড়ে পালানো ১৫-২০ জনের ওই কিশোর গ্যাং এর পেছনের দিকে একজনের ঘাড়ে নূর ইসলামের ওই ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখা যায়।
এর একদিন আগে বুধবার রাত পৌনে ২টার দিকে দুর্গা মন্দিরের অদূরে জাফরাবাদের ইত্যাদি মোড়ে বাসায় ঢুকে একই পরিবারের ৭ জনকে কুপিয়ে জখম করেছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। আহতরা হলেন- স্বপন, সাব্বির, রাব্বি, কাসেম, আফজাল, ফাতেমা বেগম ও মামুন। এদের মধ্যে গুরুতর আহত চারজন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছেন। ভুক্তভোগী আফজাল হোসেন বলেন, বুধবার রাতে আমরা বাড়ির সামনে বসে ছিলাম। হঠাৎ দেখি দুইজন কমবয়সী ছেলে আমাদের বাড়ির আশপাশে উঁকি দিচ্ছে। তখন আমি তাদের ডেকে জিজ্ঞাসা করি তোমরা কারা। এ সময় কিশোরগুলো এমনভাবে কথা বলছিল- মনে হলো তারা কোনো অপরাধ করতে এসেছে। তখন আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা রাব্বি তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করায় তারা আরও উত্তেজিত হয়ে মারতে আসে। এর একপর্যায়ে তারা ফোন দিলে ৪-৫ মিনিটের মধ্যে দেশীয় ধারালো অস্ত্রশস্ত্রসহ তাদের গ্রুপের আরো ২০-২৫ জন এসে আমাদেরকে এলোপাতাড়ি কোপানো শুরু করে। এতে আমার হাতের রগ কেটে যায় এবং আমার পরিবারের ৭ জন সদস্য গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এদের মধ্যে আমার বড় ভাই স্বপনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিনি বলেন, একজন ভয়ে বাথরুমে ঢুকলে সেখানেও ঢুকে এলোপাতাড়ি কোপায় সন্ত্রাসীরা। আমাদের বাথরুম এবং বাড়ির সিঁড়ি রক্তে ভেসে গেছে। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফাতেমা বেগম বলেন, বাসায় ওয়াসার পানি সংগ্রহ করতে আমরা প্রতিদিন রাত দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত জেগে থাকি। বুধবার রাতে বাড়ির সামনে আমার ভাতিজা রাব্বির সঙ্গে কোনো একটা ছেলের বাকবিতণ্ডা হয়। এর কিছুক্ষণ পর দেখি ১৫-২০ জনের একটি দল দেশীয় ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভাতিজাকে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। এ সময় তাদের বাঁচাতে যারাই এসেছে সবাইকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যায়। আমি ধরতে গিয়ে আমার নিজেরও পায়ে একটি কোপ লেগেছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুরের সিটি হাউজিং এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহ রাকিব হোসেন (২১) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় গণপিটুনিতে রাকিবের সহযোগী মিলন হোসেন (৩৮) আহত হন। তাকে পুলিশ পাহারায় শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জামিল আহমেদ নামে এলাকাটির এক বাসিন্দা বলেন, আমরা এতদিন ভালোই ছিলাম। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে আবারও মনে আতঙ্ক ঢুকেছে। সন্ধ্যার পর কোথাও একা যেতে ভয় লাগছে। বিশেষ করে বাসার সামনেও বের হতে ভয় লাগে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার ভোরে এক ছিনতাইকারী এলাকাবাসীর গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে তারা যদি আবারও প্রতিশোধ নিতে আসে। এই ভয়ও আমাদের মাঝে কাজ করছে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ভোরে বসিলা সিটি হাউজিং এলাকায় কয়েকজন ছিনতাইকারী প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ছিনতাই শুরু করে। এ সময় খবর ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। পরে এলাকাবাসী জড়ো হয়ে তাদের ঘেরাও করে। শেষে তিনজনকে আটকের পর গণপিটুনি দেয়া হয়। এতে রাকিব (২৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। রাকিবের গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার দুলারহাট উপজেলার নুরাবাদ এলাকায়। বাকি দু’জনকে পরে পুলিশে সোপর্দ করেন এলাকাবাসী।
মো. লিয়াকত আলী নামে মেট্রো হাউজিং এর এক বাসিন্দা বলেন, ৫ই আগস্টের পর থেকে মোহাম্মদপুর হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে। একের পর এক কিশোর গ্যাং মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এদের কেউ দিনে রাজমিস্ত্রি, কেউ চা বিক্রেতা কিংবা প্রাইভেটকার চালক। তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই ওরা ধারণ করে ভয়ঙ্কর রূপ। ধারালো অস্ত্র হাতে নিয়ে তারা যা খুশি তাই করছে। কখনো দোকানে ঢুকে চাঁদা চাচ্ছে। কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিনতাই করছে। মন চাইলে কোপ দিচ্ছে। তাদের এই ধারালো অস্ত্রের কোপে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ আবার চিরদিনের মতো পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। ব্যক্তির সঙ্গে তাদের পরিবারগুলোও শেষ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, রাস্তায় তো দূরের কথা, বর্তমানে আমরা বাসার মধ্যেও নিরাপদ নই। এর আগে গত মঙ্গলবার মোহাম্মদপুরে বেলা ৩টার দিকে মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার আজিজ খান রোড, মেকআপ খান রোড এবং প্রেমতলা গলিতে ‘লও ঠেলা’ গ্রুপের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা চাপাতি হাতে এলাকায় মহড়া দেয় এবং এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। এরপর রায়ের বাজার মেকাপ খান রোড ও বোর্ড গার্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে লও ঠেলা গ্রুপের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়াও মোহাম্মদপুরের আতঙ্ক কিশোর গ্যাং-প্রধান কব্জিকাটা আনোয়ারকে গ্রেপ্তারের পর এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে তার অনুসারীরা। কুপিয়ে জখম, বাড়ি ও দোকানে হামলা-ভাঙচুরসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়াচ্ছে এই গ্যাংয়ের সদস্যরা। তাদের কাজে বাধা দেয়ায় পুলিশ সদস্যদেরকে ধাওয়া করে, বিট পুলিশের অফিসে হামলা পর্যন্ত করেছে তারা। মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড়, চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, বসিলা চল্লিশ ফিট, কাঁটাসুর, তুরাগ হাউজিং, আক্কাস নগর, ঢাকা উদ্যান নদীর পাড়, চন্দ্রিমা হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, বসিলা হাক্কার পাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় একাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়।
এসব বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, আমরা এইসব ঘটনার প্রতিটিতেই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এসব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছে সবাইকে অতিদ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা নিয়মিত অপরাধীদেরকে আটকও করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুয়েল রানা বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ধরতে প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। তবে তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে হঠাৎ এসে হামলা করে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এই চক্রগুলো নির্মূলে আমাদের জোরালো অভিযান শুরু হবে। আশা করছি, খুব শিগগিরই এসব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারবো।