Image description
সিলেটে ওরস

শনিবার মধ্যরাত। পুলিশ লাইন থেকে মাজারে ঢোকার সড়ক। দূর থেকে ভেসে আসছে ধোঁয়ার দুর্গন্ধ। পাগলবেশে শতাধিক লোক। দলবেঁধে গাঁজা টানছে। চোখ লাল। কোথায় এসেছেন? প্রশ্ন করা হলে একজন বলে উঠলেন- ‘তুমি জানো না, আমরা বাবার মাজারে এসেছি। সকাল থেকে বাবার ওরস।’ তাহলে ওখানে কেন? জানালেন; ‘ওরা বসতে দেয় না। আলেমরা ক্ষেপেছে। এজন্য বাবাকে সালাম দিয়ে মাজার থেকে দূরে বসে আছি।’

গতকাল সকাল থেকে ওলিকুলের শিরোমনি হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে দু’দিনব্যাপী ওরস শুরু হয়েছে। এবারের ওরস ব্যতিক্রম। বলা হচ্ছে; সাড়ে ৭০০ বছরের প্রথা ভেঙে অনৈসলামিক ও অসামাজিক কাজ বন্ধ রেখে ওরস উদ্‌যাপিত হচ্ছে। যেখানে ভূমিকা রাখছেন যৌথ টিম। ওই টিমে মাজার কর্তৃপক্ষ, আলেম সমাজের প্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তারা রয়েছেন। ওরস মানে গানের আসর। নাচের মেলা। এবার সেটি হচ্ছে না। হচ্ছে কাওয়ালি, মাজার জিয়ারত, কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিল। বিকাল তখন চারটা। মিরের ময়দানের পুলিশ লাইন এলাকা দিয়ে মাজার রোডে ঢুকতে ডান দিকে চোখে পড়লো গাঁজাসেবীদের আনাগোনা। লাল কাপড়ে দলবেঁধে বসে আছে। কাছে যেতেই সবাই সতর্ক। কেউ কেউ গাঁজা টানছেন। গাঁজার গন্ধে পুরো এলাকা দুর্গন্ধযুক্ত। দরগাহের পেছনের দিক হওয়ায় ওদিকে অনেকেই যাচ্ছেন না। কেবল রাস্তা ধরে মানুষজন হাঁটা-চলা করছেন।

কথা হয় চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার থেকে আসা ভণ্ড ফারুক মিয়ার সঙ্গে। গাঁজার নেশায় বুঁদ সে। ওরসে এবারের ‘বাধ্যকতায়’ ক্ষুব্ধ। ফারুক বলেন- ‘ত্রিশ বছর ধরে ওরসে আসছি। এই একদিনের জন্য আমরা দেশের সব ভক্তরা মিলিত হয়েছি। এখন আমাদের মাজার এলাকায় ঢুকতেই দিচ্ছে না। বসে বসে গাঁজা টানছিল হরণদর নাথ। সাংবাদিক শুনেই গাঁজার ‘কলকি’ লুকিয়ে ফেলে। জানান- ‘প্রতি বছর শত শত গাঁজাখোর এক সঙ্গে ওরসে আসে। গতবার পর্যন্ত তারা ঝরনারপাড় ও মোতাওয়াল্লির বাড়ির ওখানে বসতে পেরেছিলেন। এবার ওই জায়গায় বসতে দেয় না।’ ওরসে শালীনতা বজায় রাখতে আগে থেকেই তৎপর ছিলেন ‘হযরত শাহজালাল (রহ.) তাওহিদি কাফেলা’র নেতারা। প্রায় এক মাস ধরে তারা সিলেটের প্রশাসনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছিলেন।

সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন; ওরসে অনৈসলামিক ও অসামাজিক কাজ বরদাশত করা হবে না। তাদের দৃঢ় অবস্থানের কারণে প্রশাসনও সক্রিয় হয়। সবাইকে নিয়ে বৈঠক করেন। সর্বশেষ দরগাহে মাজার কর্তৃপক্ষ, ‘হযরত শাহজালাল (রহ.) তাওহিদি কাফেলা’র নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। ওরসে কী করা যাবে- কী করা যাবে না- এ নিয়ে বিধিনিষেধ  দেন তারা। এজন্য নতুন করে কিছু প্রস্তাবনা আসে। এতে যুক্ত হয় কাওয়ালি। শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এ কাওয়ালির আয়োজন করা হয়। ওরস চলাকালে যাতে মাজারে অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। প্রতিটি ফটকে তল্লাশির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

‘হযরত শাহজালাল (রহ.) তাওহিদি কাফেলা’র সদস্য সচিব মাওলানা শাহ মমশাদ আহমদ জানিয়েছেন- এবার একটি ব্যতিক্রমী ও পবিত্র ওরস উপহার দিতে আমরা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনের প্রশংসনীয় সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। এ ছাড়া মাজার কর্তৃপক্ষও আন্তরিক। তিনি জানান- ওরসে অনৈসলামিক-অসামাজিক কাজ বন্ধে শাহজালাল (রহ.) তাওহিদি কাফেলার পক্ষ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবগুলো যৌক্তিক এবং সুন্দর বলে স্বীকার করেন মাজার কমিটি। তারা এ প্রস্তাবের অনেকগুলোকে এবার পালন করছেন। মাজারের অন্যতম খাদেম এ এম এন জামান চৌধুরী ওরসের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন- অন্যান্যবারের মতো এবার গান-বাজনা হচ্ছে না, বসছে না মদ-গাঁজার আসর। এবারের ওরস শিরক-বিদাআতমুক্ত পরিবেশ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. রেজাউল করিম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- মাজারের ওরস আরও সুশৃঙ্খল ও পবিত্র পরিবেশে সম্পন্নের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন, মাজার কর্তৃপক্ষ, আলেম-উলামা ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত তদারকি কমিটি ওরস চলাকালীন সর্বদা মনিটরিং করছেন। ওরসকালীন মাজারের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে এবার ভক্তবৃন্দের প্রতি বলা হচ্ছে- সবাই যেন মাজারে সিজদা প্রদানসহ সকল শিরকি ও বিদাআতি কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন। নারীরা পর্দার সঙ্গে অবস্থান করেন। কেউ যেন মদ-গাঁজার আসর না বসান। এসব বিষয় তদারক কমিটি সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখছে। এ ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন টিম মাজার প্রাঙ্গণে সার্বক্ষণিক সতর্ক অবস্থানে থাকছে। ঠেকাবে সব অসামাজিক-অনৈসলামিক ও বিশৃঙ্খল কাজ। মাজার প্রাঙ্গণে চুরি-ছিনতাই ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড রোধেও কাজ করছে পুলিশ। সাদা পোশাকে অবস্থান করছে আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।