Image description
 
১.
শেখ হাসিনার শাসনামলেই সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পায় বিদেশিরা। ২০২৩ সালে ২২ বছরের জন্য পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালার দায়িত্ব পায় সৌদি আরবের RSGTI. অনেকেই হয়ত জানেন না যে, এই কোম্পানির ২০% শেয়ার হোল্ড করে চায়নার রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি CSPL; ২০% শেয়ার হোল্ড করে সৌদির পিআইএফ। ফলে ২০২৩ সালে RSGTI-এর সাথে চুক্তিটা যেভাবেই হোক, এর ফলে চায়নার যে একটা লাভ হইছে, তা বলাইবাহুল্য।
২.
RSGTI-এর সাথে চুক্তির পর প্রায় ২ বছর পার হইছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার পতনও হইছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর এই চুক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য উইঠা আসতেছে।
সিপিএ-র তৎকালীন চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল শেখ হাসিনারে চিঠি লেইখা এই চুক্তিতে বন্দর ও দেশের সম্ভাব্য ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন। ১ মাসের মধ্যে তার জায়গায় আসেন রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহেল।
পিসিটি’র জন্য ব্যবসায়িক মডেল তৈরি ও RSGTI-এর সাথে চুক্তির খসড়া তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান IFC-কে এই চুক্তির লেনদেন উপদেষ্টা হিশাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু সেসময় সিপিএ এর বিরোধিতা করে ২ টা গ্রাউন্ডে:
১. IFC নিজেই বাঙলাদেশের বে টার্মিনাল প্রকল্পে ইনভেস্ট করবে। ফলে সে শুধু নিরপেক্ষ পরামর্শদাতা না, বিনিয়োগকারীও বটে। এইটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট।
২. পিসিটি চুক্তির শর্তগুলা ভবিষ্যতের জন্য বেঞ্চমার্ক। ফলে এইখানে কোনো ঝামেলা হইলে এটা ফিউচার পিপিপি প্রকল্পগুলারেও প্রভাবিত করবে।
তবু IFC-ই চুক্তির খসড়াটা করে। IFC-র সাবেক বিনিয়োগ বিশ্লেষক সুমায়া মাহমুদ এই খসড়া তৈরির সাথে যুক্ত ছিলেন। গত ১২ আগস্ট উনি দাবি করেন যে, ‘যেভাবেই হোক প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করার জন্য এবং ডিউ ডিলিজেন্সের সঙ্গে আপস করতে আমাদের ওপর চরম অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।’ পরে এ ব্যাপারে সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট করলে তারে ‘পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়’।
সিপিএ-র সাবেক চেয়ারম্যানের মতে, সালমান এফ রহমান ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর প্রত্যক্ষ প্রভাবে এই চুক্তি সম্পাদিত হইছে।
৩.
প্রভাব খাটায়ে করা এই চুক্তির ২/১ টা দিক নিয়া আলাপ করা যাক। সাধারণত বন্দরগুলো থেকে সিপিএ কন্টেইনারপ্রতি ৮০-৯০ ডলার পায়। চুক্তি অনুযায়ী, পিসিটি থেকে কন্টেইনারপ্রতি সিপিএ পাবে ১৮ ডলার, বাকিটা পাবে RSGTI. আবার এইটাও পাবে বছরের প্রথম ২.৫ লাখ কন্টেইনারে; কিন্তু বন্দরের সক্ষমতা ৫ লাখ কন্টেইনার। ফলে বাকি ২.৫ লাখে তারা ট্যারিফের অর্ধেক পাবে। রাজস্ব বন্টন হবে ৭০-৩০ হারে, যেখানে RSGTI পাবে ৭০%৷
৪.
এনিওয়ে, উন্নয়নের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়া RSGTI-কে বন্দরটা দেওয়া হইছিল, চুক্তির ২ বছর পর সেগুলার কী অবস্থা? এককথায়, বাজে অবস্থা।
চুক্তির ২ বছর পরেও পিসিটি তার সক্ষমতার ১৫% এরও কম ব্যবহৃত হচ্ছে। যন্ত্রপাতি ও অপারেটরের অভাবে প্রায় ১৪ হাজার কন্টেইনার পরিচালনায় সক্ষম পিসিটিতে দৈনিক গড়ে মাত্র ১৭৮ টা কন্টেইনার পরিচালিত হচ্ছে। স্ক্যানার না থাকায় শুধু রপ্তানি হচ্ছে, আমদানি হচ্ছে না।
প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব নিতে মাত্র ২২০ কোটি টাকা জামানত রাখছে RSGTI. অভিযোগ আছে যে, বন্দরের আয় দিয়াই তারা বন্দরের সরঞ্জাম কিনতেছে, নিজেদের উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ নাই।
৫.
অনুরোধ সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পিসিটির এই চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন তো করে নাই। বরং সিপিএ-র বর্তমান সেক্রেটারি ওমর ফারুক সাহেব বলছেন যে, এই চুক্তি সিপিএ বা দেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতিই করে নাই; এটা সিপিএর ফেভারেই আছে।
কেন সিপিএর এই অবস্থান, তা বোঝা মুশকিল হইলেও অসম্ভব না।
সিপিএ-র নিয়ন্ত্রণাধীন আরেকটা টার্মিনাল নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ডরে দেওয়ার আলোচনা চলমান। এছাড়া নির্মানাধীন মাতারবাড়ি পোর্টের ব্যাপারেও ডিপি ওয়ার্ল্ডের আগ্রহ আছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে এই চুক্তির তোড়জোড় আওয়ামী আমলেই শুরু হইছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা যেকোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে বইলা মনে হয়।
৬.
ডিপি ওয়ার্ল্ডের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে এখন। ২০০৬ সালে ‘নিরাপত্তাজনিত কারণে’ ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিজেদের ৬ টা পোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত করে ইউএস। যদিও প্রেসিডেন্ট বুশ সেসময় ডিপি ওয়ার্ল্ডের পক্ষে ছিলেন।
নিজেদের দেশে পোর্ট পরিচালনার দায়িত্ব না দিলেও, পৃথিবীর বহু বন্দরে ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে ইউএস নেভির স্ট্রাটেজিক রিলেশন আছে/ছিল। যেমন: জিবুতি পোর্ট (জিবুতি), পোর্ট জেবেল আলি (আরব আমিরাত), পোর্ট ফুজাইরা (আরব আমিরাত), পোর্ট সালালা (ওমান) ইত্যাদি।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে ইজরাইলের সম্পর্ক নিয়াও আলোচনা চলমান। ২০২০ সালে ইজরাইলি কোম্পানি ডোভার টাওয়ারের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যায় ডিপি ওয়ার্ল্ড। এই ভেঞ্চারের আওতায় জেবেল আলি পোর্টের সাথে ইজরাইলি পোর্টগুলার একটা শিপিং লাইন ও স্ট্রাটেজিক করিডোর তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা সরাসরি IMEC (মিডল ইস্ট-ইন্ডিয়া-ইউরোপ ইকোনোমিক করিডোর) প্রজেক্টের সাথে যুক্ত।
এছাড়া ইজরাইলের বিভিন্ন পোর্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব নিতেও আগ্রহী ডিপি ওয়ার্ল্ড। ফলে ২০২০ সালে হাইফা বন্দরের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বিড করছিল তারা। যদিও নানা কারণে বিডটা তারা জিততে পারে নাই। তবে এশিয়া ও আফ্রিকার মার্কেটে ঢোকার জন্য ইজরাইলের কাছে এই মুহূর্তে স্ট্রাটেজিক্যালি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হইল জেবেল আলি পোর্ট। তাই ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে ইজরাইলের সম্পর্ক দিন দিন আরো বাড়বে বইলাই মনে হয়।
৭.
কিন্তু তা হবে বইলা মনে হয় না। সমস্ত রাজনৈতিক দলই অলরেডি বন্দর ইস্যু নিয়া আলাপ তুলছে। আলাপ উঠছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট নিয়া। দেশের ইন্টার্নাল সিক্যুরিটি নিয়া অস্বস্তি তৈরি হইছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন আওয়ামী আমলের প্রজেক্ট ও চুক্তিগুলারে পুনর্মূল্যায়ন ছাড়াই এগিয়ে নিচ্ছে ইন্টেরিম।
এসব আপত্তির বিপরীতে ইন্টেরিমের যুক্তি সেই উন্নয়ন আর কর্মসংস্থানের বুলিই। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৬ বছরের ফ্যাশিস্ট শাসন বাঙলাদেশে উন্নয়ন অর্থনীতির গোমর ফাঁস করে দিছে। মানুশ এখন আর সহজে উন্নয়নের বুলি বিশ্বাস করে না। ইন্টেরিমের সেটা বুঝতে হবে। RSGTI-এর সাথে উন্নয়নমূলক চুক্তির আড়ালে কী ছিল, এবং এই চুক্তি কতটুকু উন্নয়ন ঘটাইতে পারছে, তা এখন স্পষ্ট।
৮.
বন্দর বিদেশিদের দিলে বেশি ভালো হবে, না দেশিয় অপারেটররাই ভালো চালাইতে পারবে— এসব এক্সপার্টদের তর্ক। আই ডোন্ট নো শিট অ্যাবাউট ইট। বাট তত্ত্ব আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক থাকে যোজন যোজন। তত্ত্ব দিয়া যেখানে উন্নয়নের বাম্পার ফলন দেখানো যায়, বাস্তবে সেখানে অশ্বডিম্বও থাকতে পারে। এর প্রমাণ অসংখ্য, অগণিত। আমরা গত ১৬ বছর যাবত এর ভিক্টিম হইছি। ফলে এটা শুধু ইকোনোমিক সায়েন্সের ইস্যু না; থিওরির ইস্যু না। এটা পলিটিকাল ও সাইকোলজিকাল। ইন্টেরিমের সেটা বুঝতে হবে।
তাছাড়া এ ধরনের চুক্তিতে গোপনীয়তা থাকে, মানুশ অনেক কিছু জানতেই পারে না। যেমন RSGTI-র সাথে করা চুক্তিতে যে এত জটিলতা ও সমস্যা ছিল, কেউ কি জানত? জানত না। ফলে ইন্টেরিমের বন্দর প্রজেক্ট নিয়া অস্বস্তি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।
ইন্টেরিমের উচিত এসব অস্বস্তি আমলে নেওয়া এবং সে-অনুযায়ী নিজেদের স্ট্রাটেজি সাজানো। গায়ের জোরে কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।