
দেশে দেড় দশক ধরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে বিনা মূল্যে টিকা দিচ্ছে সরকার । শুরুর প্রায় পাঁচ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ( ডব্লিউএইচও ) প্রি - কোয়ালিফায়েড টিকা আমদানি করে দেওয়া হয়েছে । এক দশক ধরে দেওয়া হচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের তৈরি টিকা । জানা গেছে , এক দশক ধরে দেশীয় ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তৈরি র্যাবিক্স - ভিসি টিকা কিনছে সরকার । জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন , মানবদেহে প্রয়োগ করা টিকার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, জলাতঙ্কের বর্তমান টিকার প্রি-কোয়ালিফিকেশন না থাকলেও এটি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদিত । অবশ্য ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস বলেছে , কোনো দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের প্রি-কোয়ালিফিকেশন না থাকলে ডব্লিউএইচও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে এই সনদ দেয় না । তাদের এই টিকা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে । এখন পর্যন্ত টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিযোগ আসেনি । দেশে জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য ২০১০ সালে ‘ জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচি' নেয় সরকার ।
পরের বছর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ যুক্ত হয় । সেই থেকে দেশে বিনা মূল্যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে টিকা দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ( সিডিসি ) । ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে জলাতঙ্কমুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে । স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জুনোটিক ডিজিজ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সূত্র জানায়, কুকুর, বিড়াল, বেজি, খ্যাঁকশিয়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর কামড় , আঁচড়ের কারণে র্যাবিস ভাইরাসের ( জলাতঙ্ক ) সংক্রমণ ঘটে । আক্রান্ত ব্যক্তিকে তিন থেকে চার ডোজ র্যাবিস টিকা দিতে হয় । প্রাণীর আক্রমণে রক্তাক্ত আহতদের অতিরিক্ত হিসেবে র্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন ( আরআইজি ) দেওয়া হয় । এক ভায়াল টিকার দাম স্থানীয় বাজারে ৫০০ টাকা । আরআইজির দাম ১ হাজার টাকা । সারা দেশে উপজেলা , জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর চার শতাধিক টিকাকেন্দ্রে প্রাণীর আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের বিনা মূল্যে এই টিকা দেওয়া হয় । সরকারের হিসাবে, গত বছর কুকুরসহ প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়ে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে আসে সোয়া ৫ লাখ মানুষ । গত বছর জলাতঙ্কের কারণে মারা যায় ৫৬ জন ।
সূত্র জানায় , ২০১২ সালে এক লাখ রোগীকে এআরভি দেওয়া হয় । ২০২৩ সালে এই টিকা নিতে হয়েছে ছয় লাখের বেশি রোগীকে । স্বাস্থ্যের কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের ( ওপি ) মাধ্যমে জলাতঙ্কের টিকা দিত অধিদপ্তর । ওপির মাধ্যমে সিডিসি সরাসরি টিকা কিনত । গত জুনে' চতুর্থ স্বাস্থ্য , জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি ( এইচপিএনএসপি ) শেষ হলেও পঞ্চম এইচপিএনএসপি বা ওপি অনুমোদন হয়নি । ফলে ওপি না থাকায় সরকারের বিশেষ বরাদ্দে এই টিকা কিনছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ( সিএমএসডি ) । গত ফেব্রুয়ারিতে সিএমএসডি সোয়া এক লাখ টিকা কেনে । সেই টিকা শেষের পথে । এখন প্রায় তিন লাখ টিকা কেনার প্রক্রিয়া চলছে । সরকার এখন আরআইজি কিনছে না ।
শুরুতে দেওয়া হয় বিদেশি টিকা: ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির শুরুতে আমদানি করা রাবিপুর ও ভেরোরাভ টিকা দেওয়া হতো । ভেরোরাভ টিকা ফ্রান্সের সানোফি এসএর এবং রাবিপুর ভারতের চিরন বেহরিং ভ্যাকসিন প্রাইভেট লিমিটেডের তৈরি । এই দুই টিকাই ডব্লিউএইচওর প্রি - কোয়ালিফায়েড । গত দেড় দশকে দেশে প্রায় ৪০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হয় । এগুলোর মধ্যে রাবিপুর ও ভেরোরাভ টিকা দেওয়া হয় পৌনে ৯ লাখ । ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ( রোগ নিয়ন্ত্রণ ) ও লাইন ডিরেক্টর ( সিডিসি ) ছিলেন অধ্যাপক ডা . বে - নজির আহমেদ । জাতীয় টিকাদান - সংক্রান্ত কারিগরি পরামর্শক কমিটির সাবেক এই সদস্য জানান , তিনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় র্যাবিসের টিকা হিসেবে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ( আইপিএইচ ) নার্ভ টিস্যু ভ্যাকসিন ( এনটিভি ) পেটে
দেওয়া হতো । পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে সেই টিকা প্রয়োগ বন্ধ করে আরও কার্যকর ও নিরাপদ টিস্যু কালচারভিত্তিক ভ্যাকসিন ( টিসিভি ) প্রয়োগের পরামর্শ দেয় ডব্লিউএইচও । ডা . বে - নজির আহমেদ বলেন , টিকাগুলো যেন ডব্লিউএইচওর প্রি- কোয়ালিফায়েড হয় , সে জন্য প্রকিউরমেন্টের স্পেসিফিকেশনে ( ক্রয়সংক্রান্ত উপকরণের বিবরণ ) বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয় । জলাতঙ্ক নির্মূলের জাতীয় কমিটি তা নির্ধারণ করে । এটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । আমরা সে অনুযায়ী টিকা কিনি । দরপত্রে ইনসেপ্টাও অংশ নিলেও পি- কোয়ালিফিকেশন না থাকায় তাদের টিকা আমরা নিইনি । কেননা, প্রি-কোয়ালিফিকেশন না থাকায় এই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না । ” স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান , ২০১৫ সাল থেকে ইনসেপ্টার ‘ র্যাবিক্স - ভিসি ’ টিকা প্রয়োগ শুরু হয় । তবে সে সময় এই টিকা প্রয়োগের জন্য জাতীয় কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি । ক্রয় বিবরণ থেকে ‘প্রি-কোয়ালিফিকেশন' শর্ত তুলে নেওয়া হয় ।
ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী , ভেরোরাব ২০০৫ সালের জুনে প্রি- কোয়ালিফিকেশনের তালিকায় স্থান পায় । কয়েক বছর ধরে রাবিপুর টিকা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান । টিকাটি বর্তমানে চিরোরাভ নামে বিশ্ববাজারে রয়েছে । যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে , ডব্লিউএইচওর টিকার প্রি - কোয়ালিফিকেশন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনপ্রক্রিয়া , পরীক্ষাগার , গবেষণা , টিকা প্রস্তুতের সব পর্যায়ের সূক্ষ্ম নিরাপত্তাসহ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয় । বিশেষজ্ঞরা বলছেন , কোনো কোম্পানি টিকা তৈরির আগে ডব্লিউএইচওকে জানায় । তারা তখন উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সব ধাপ পর্যালোচনা করে । বিশ্বের সব ওষুধ কোম্পানি টিকা তৈরি করে না । বাংলাদেশে যেসব টিকা তৈরি হয় , তা মূলত আমদানি করা তৈরি পণ্য ( ফিনিশড প্রোডাক্ট ) বোতলজাতকরণের মাধ্যমে । ভারত সবচেয়ে বেশি টিকা উৎপাদন করে ।
ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান টিকার প্রি - কোয়ালিফিকেশন না পাওয়ার কারণ জাতীয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের ( এনআরএ ) প্রি - কোয়ালিফিকেশন না থাকা । অর্থাৎ একটি দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষাগারকে প্রথমে এই মানদণ্ডে উন্নীত হতে হবে । ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি ( এনডিসিএল ) ওষুধের প্রি- কোয়ালিফিকেশন অর্জন করেছে , তবে টিকার জন্য হয়নি । এনআরএ মানদণ্ডে উন্নীত না হলে কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রি - কোয়ালিফিকেশন দেয় না ডব্লিউএইচও ।’
সূত্র বলেছে , সরকার এক দশক ধরে র্যাবিক্স-ভিসি টিকা কিনছে । ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত কেনা হয় ওপির মাধ্যমে । বর্তমানে সরকারের বিশেষ বরাদ্দে কিনছে সিএমএসডি । রাবিক্স - ভিসি ব্র্যান্ড নামে র্যাবিসের এই টিকা ২০১১ সালের নভেম্বরে দেশের বাজারে আনে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইনসেপটা ভ্যাকসিন লিমিটেড । ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ( ডিজিডিএ ) সূত্র জানায় , ডিজিডিএর অনুমোদন পেতে হলে ডব্লিউএইচওর প্রি - কোয়ালিফায়েড হওয়ার শর্ত নেই । ইপিআইয়ের টিকাগুলো দেয় জাতিসংঘ শিশু তহবিল ( ইউনিসেফ ) । তারা প্রি-কোয়ালিফায়েড টিকা সংগ্ৰহ করে ।
স্থানীয় টিকা উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিদেশ থেকে আমদানিতে ডিজিডিএর অনুমোদন লাগে । দেড় দশক ধরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধ ও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন এমন একজন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ আজকের পত্রিকাকে বলেন , বর্তমান টিকা প্রি - কোয়ালিফায়েড নয় , এটি ডিজিডিএ অনুমোদিত । তবে প্রি - কোয়ালিফায়েড টিকার নিরাপত্তা সর্বোচ্চ । অবশ্য ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস বলছে , দেশের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের টিকার প্রি- কোয়ালিফিকেশন না থাকলে ডব্লিউএইচও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে দেয় না । তাদের এই টিকা বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে । এখন পর্যন্ত কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিযোগ নেই ।
ইনসেপটার চেয়ারম্যান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ দেশে ওষুধ বা টিকা উৎপাদন বাজারজাতের বিষয়টি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করে । প্রি - কোয়ালিফিকেশন ঔষধ প্রশাসনকে আগে নিতে হবে । ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যদি ডব্লিউএইচওর ম্যাচিউরিটি লেভেল -৩ অর্জন করে , তবে অধিদপ্তর যাদের টিকার অনুমোদন দিয়েছে , তাদেরকেও প্রি- কোয়ালিফিকেশনের জন্য বিবেচনা করবে তারা ।
তিনি বলেন , “আমরা গোড়া থেকে ডব্লিউএইচওর নিয়ম অনুযায়ী সবকিছু বানিয়েছি । ওষুধের জন্য আমাদের প্রি-কোয়ালিফিকেশন রয়েছে । ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর টিকার জন্য এমএল -৩ অর্জন করলে আমরাও প্রি-কোয়ালিফিকেশনের অনুমোদন পাব । টিকা আমদানির ক্ষেত্রে প্রি - কোয়ালিফিকেশন লাগে , দেশীয় টিকার ক্ষেত্রে লাগে না ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ( সিডিসি ) ডা . মো . হালিমুর রশিদ বলেন , “ যেকোনো প্রি - কোয়ালিফায়েড টিকাই ভালো । কিন্তু দরপত্র আহ্বান করা হলে সেসব প্রতিষ্ঠানগুলো অংশ নেয় না । এ ছাড়া উচ্চ আদালতের রায় আছে , যে টিকা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় , সেই টিকা আমদানি করা যাবে না । ” স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা . আবু জাফর আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ ইনসেপ্টার টিকার প্রি - কোয়ালিফিকেশন নেই । টিকাটি ঔষধ প্ৰশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদিত । ইউনিসেফ প্রি- কোয়ালিফায়েড টিকা কেনার শর্ত দিয়েছিল । তবে শর্ত ছাড়াই এই টিকা অনেক বছর ধরে কেনা হচ্ছে । আমরা বিষয়টি আমলে নিয়েছি । এই টিকা পরীক্ষার জন্য নমুনা বিদেশে পাঠানো হয়েছে , এমন একটি চিঠি তারা আমাদের দিয়েছে ।'