
পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ানো ও বেশিসংখ্যক জিপিএ ৫ পেতে শিক্ষা বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের যোগসাজশে দেশব্যাপী একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। চক্রটি পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেয় এবং নকল সরবরাহ করে। ভেন্যু কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের খাতায় উত্তর লিখে দেওয়ার মতো গুরুতর ঘটনাও ঘটছে। এসব অনৈতিক সুবিধার কারণে বেসরকারি কিছু কলেজের পরীক্ষার ফলে অস্বাভাবিক উল্লম্ফন দেখা গেছে।
সূত্র বলছে, চলমান এসএসসি পরীক্ষায় দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার তথ্য আসার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বোর্ডগুলোকে কেন্দ্রের ব্যাপক রদবদল এবং ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল করার নির্দেশনা দেয়। এরই মধ্যে ঢাকা ও যশোর শিক্ষা বোর্ড ১০২টি ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল করেছে। বাকিরা তালিকা প্রস্তুত করছে। সারা দেশে সাড়ে ৪০০ কেন্দ্র বাতিল এবং ১১০০ কেন্দ্র রদবদল হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে এবারের ফলে ছন্দপতন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কালবেলার অনুসন্ধান, পরীক্ষার হলে হলে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট, শিক্ষকদের যোগসাজশ, বহিরাগতদের দিয়ে উত্তর লেখানোসহ প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুতর প্রমাণ মিলেছে। শিক্ষকদের যোগসাজশে দুর্বল শিক্ষার্থীকে কম কড়াকড়ি এবং তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্থীকে ভালো কেন্দ্রে বসিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার তথ্য মিলেছে। এসব সুবিধা নিয়ে দেশের কিছু বাণিজ্যিক কলেজ গড় পাসের হার ও জিপিএ ৫ বাড়িয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের নথিতে থাকা বেসরকারি কলেজগুলোর মধ্যে ক্যামব্রিয়ান কলেজের ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এক যুগের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কলেজটি ঈর্ষণীয় ফলাফল করেছে। এই চার বছরের মধ্যে দুই বছর শতভাগ শিক্ষার্থী পাস, বাকি দুই বছর ৯৯ শতাংশের বেশি পাস ছিল। জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০২০, ২০১৫ এবং ২০১৪ সালে কলেজটিতে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করে। সবচেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পায় ২০১৩ সালে ৯৪১ জন। এরপর ২০১৪ সালে ৭৩৩ জন, ২০১৫ সালে ৬৯০ জন এবং ২০১২ সালে ৬৫১ জন জিপিএ ৫ পায়। ওই বছরগুলোতে এই কলেজের পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল বাড্ডার আলাতুন্নেছা স্কুল ও বনানী বিদ্যানিকেতনে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই এক যুগের মধ্যে যখন ভালো ফলাফল করেছে তখন ঘুরেফিরে এই কেন্দ্রগুলোতে পরীক্ষা হয়েছে। অন্যদিকে বিএফ শাহীন কলেজসহ তুলনামূলক কড়াকড়ি আছে এমন কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার কারণে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০১৩ সালে কলেজটির ফলাফলে ধস নামে। ওই বছরগুলোতে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যথাক্রমে ২৬, ১৭, ১৯ ও ৩৩-এ নেমে আসে এবং পাসের হার ৯০ শতাংশের নিচে চলে যায়।
ওই সময় ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর জিয়াউল হক। তিনি কালবেলাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে শিক্ষকদের যোগসাজশে ভালো ফল করার অভিযোগ আসার পর তিনি অনেক কেন্দ্র পরিবর্তন করেছিলেন, যার মধ্যে ক্যামব্রিয়ানও ছিল। এ ছাড়া তিনি নরসিংদীর কাদের মোল্লা কলেজের কেন্দ্র পরিবর্তন করেছিলেন। তারা তদবির করে কেন্দ্র আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে চাইলেও তিনি সেটি করেননি।
কেন্দ্রের কারিশমায় পাসের উল্লম্ফন হয় নরসিংদীর পলাশ উপজেলার সেন্ট্রাল কলেজে। শুধু কেন্দ্র পরিবর্তনের ফলে দুই শিক্ষাবর্ষে পাসের হার এবং জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যায় বড় ধরনের পতন ঘটে, যা নিয়ে শিক্ষা বোর্ড ও এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কলেজটিতে ২০২১ সালে ৩৩৮ জন পরীক্ষা দিয়ে শতভাগ পাস করে, জিপিএ ৫ পায় ৯০ জন। পরের বছর ২০২২ সালে ৩৩৭ জনের মধ্যে ৩২৯ জন পাস করে। পাসের হার ৯৭.৬৩ শতাংশ, জিপিএ ৫ পায় ১২৭ জন। এই সাফল্যে ছন্দপতন হয় যখন স্থানীয় প্রশাসনের অভিযোগে ২০২৩ সালে কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রটি ‘নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজ’ থেকে সরিয়ে ‘পলাশ শিল্পাঞ্চল কলেজে’ স্থানান্তর হয়। এর পরে ২০২৩ ও ২০২৪ দুই শিক্ষাবর্ষে পাসের হার এবং জিপিএ ৫ দুটিতেই ছন্দপতন হয়। ২০২৩ সালে পাসের হার ৯৫.৯৩ শতাংশ, জিপিএ ৫ ১২৭ থেকে এক ধাক্কায় ২৩-এ নেমে আসে। ফলের নিম্নমুখী ধারা ২০২৪ সালেও অব্যাহত থাকে। ওই বছর কলেজ থেকে মাত্র ২১ জন জিপিএ ৫ পায় এবং পাসের হার আরও কমে ৮৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে দাঁড়ায়।
প্রতিষ্ঠানটির গত ১০ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে নরসিংদী মহিলা কলেজেই পাঁচ বছর পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল। এর মধ্যে তিন বছর ছিল শতভাগ পাস। বাকি দুই বছর ৯৯ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পেয়েছে ওই বছরগুলোতে। শুধু তাই নয়, মহিলা কলেজে কেন্দ্র আসার পর তাদের জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যা হুহু করে বেড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এই কলেজ নয়, নরসিংদীর বেশিরভাগ বেসরকারি কলেজ মহিলা কলেজে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী। চলতি বছর ১১টি কলেজের কেন্দ্র এখানে। এই কলেজে মাত্র ৩০ জন শিক্ষক রয়েছেন। পরীক্ষার সময় অন্য জায়গায় ভেন্যু ভাড়া করে উপকেন্দ্র বানায় এবং স্থানীয় শিক্ষকদের দিয়ে হলে গার্ড দেওয়া হয়। তাদের সমঝোতায় হলে খাতায় লিখে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে, যা স্থানীয় প্রশাসন অবগত।
পলাশ উপজেলার শিক্ষা অফিস বলছে, পলাশ শিল্পাঞ্চল কলেজের অধ্যক্ষ নকল করার সুযোগ না দেওয়ায় চলতি বছর তিনটি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা কেন্দ্র বদল করেছে। তারা শিক্ষা বোর্ডে তদবির করে এসব কেন্দ্রে বদল করেছে। অথচ কলেজটিতে ৫ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ার মতো ব্যবস্থাপনা রয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কাছাকাছি ২-৩ কিলোমিটারের মধ্যে কেন্দ্র থাকার পরও কেন ১৮ কিলোমিটার দূরে কেন্দ্র গেল কলেজটির।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাখার এক কর্মকর্তা জানান, সেন্ট্রাল কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষরসহ আবেদন নিয়ে বোর্ডে হুমকি দেয়, কেন্দ্র পরিবর্তন না করলে কেউ পরীক্ষায় অংশ নেবে না। এতে কারও ক্ষতি হলে দায়ভার বোর্ডকে নিতে হবে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন সেন্ট্রাল কলেজের অধ্যক্ষ আমীর হোসাইন গাজী। তিনি কালবেলাকে বলেন, কোনো হুমকি দিইনি। শিক্ষার্থীদের দাবি, তারা মহিলা কলেজে পরীক্ষা দেবে। এজন্য কেন্দ্র পরিবর্তন হয়েছে। নিজ উপজেলায় তিনটি কেন্দ্র ছেড়ে ১৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার বিষয়ে একই যুক্তি তার। শিল্পাঞ্চল কলেজ থেকে বেরিয়ে যাওয়া রেসিডেন্সিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ আরিফ পাঠান কালবেলাকে বলেন, শিল্পাঞ্চল কলেজ আর আমাদের কলেজ পাশাপাশি। তাই নিজ উপজেলার মধ্যেই কেন্দ্র পরিবর্তন করিয়েছি।
পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, এমন ঘটনা ঘটলে তা খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে। উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিলন কৃঞ্চ হালদার কালবেলাকে বলেন, সব কলেজ পলাশের মধ্যে পরীক্ষা দিলেও সেন্ট্রাল কলেজ অন্য উপজেলায় চলে যাওয়াটা রহস্যজনক। এর কারণ তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে আমাদের সুপারিশে সদর থেকে পলাশে কেন্দ্র এসেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, যদি সত্যিই নকলের সুযোগ না দেওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্র পরিবর্তন করে থাকে, এটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি অশনিসংকেত।
ভেন্যু কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ফলের ‘উল্লম্ফন’
অনুসন্ধানে গত কয়েক বছরে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় কেন্দ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য হওয়ার কিছু তথ্য মিলেছে। বিশেষ করে ভেন্যু কেন্দ্রে স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষকদের পারস্পরিক সমঝোতায় প্রকাশ্যে নকল হতো। এমন কয়েকটি কেন্দ্রে ফলাফলও ছিল অস্বাভাবিক। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সব ভেন্যু কেন্দ্র বাতিলের নির্দেশ আসে মন্ত্রণালয় থেকে। এরপর ঢাকা বোর্ডে ৭১টি এবং যশোরে ৩১টিসহ মোট ১০২ ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল করা হয়। বাকি ৯টি বোর্ড এ বিষয়ে কাজ করছে। খুব শিগগির ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল করা হবে।
শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস সূত্র বলছে, রাজনৈতিক প্রভাব ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এসব ভেন্যু কেন্দ্র তৈরি করা হতো। এসব কেন্দ্রে নকল সরবরাহ, উত্তর বলে দেওয়া এবং শিক্ষকদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও কেউ ব্যবস্থা নেয়নি।
ঢাকা বোর্ড তথ্য বলছে, চলতি বছর ৭১টি ভেন্যুর সঙ্গে ১১টি কেন্দ্র বাতিল, ৬০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রদবদল করা হয়েছে। একটি পরীক্ষা কেন্দ্র করতে হলে কমপক্ষে ৬০০ পরীক্ষার্থী লাগে। ১৭১ জন শিক্ষার্থী দিয়েও ভেন্যু কেন্দ্র চালানো হতো। এমন একটি কেন্দ্র হলো টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে শমসের ফকির কলেজ। সেটি বাতিল হয়েছে। একই জেলার করটিয়ায় এইচএমএম ইনস্টিটিউটে মাত্র ২০৫ জন পরীক্ষার্থী দিয়ে ভেন্যু কেন্দ্র চলত। মজার বিষয়, এ কলেজে পরীক্ষা দিত শুধু আবেদা খানম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। নরসিংদীর মাধবদী কলেজ ২৬৫ জন পরীক্ষার্থী দিয়ে ভেন্যু কেন্দ্র চালাত। প্রায় প্রতিটি ভেন্যু কেন্দ্রের চিত্র এমন। এসব কলেজের বিগত বছরগুলোর ফলাফল অস্বাভাবিক। চলতি বছর সেই ফলাফলে ধস নামতে পারে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম কালবেলা বলেন, বিগত সময়ে সারা দেশে পরীক্ষা কেন্দ্রভিত্তিক যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তা ভাঙার নির্দেশ রয়েছে। কোনো বোর্ড যদি গাফিলতি করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির কালবেলাকে বলেন, দেশজুড়ে গড়ে ওঠা কেন্দ্রভিত্তিক সিন্ডিকেট ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল প্রকাশ হলে অ্যাকশনের ফল দেখা যাবে। বোর্ডগুলোর পরীক্ষক সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন বলেন, ভেন্যু কেন্দ্রে পরীক্ষা সংক্রান্ত অনৈতিক কাণ্ডের হাট বসত। এসব অভিযোগের কারণে ৭১টি কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে। হাওর অধ্যুষিত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা কিছু ভেন্যু বাতিল করা যায়নি, তবে সেই কেন্দ্রগুলোত ব্যাপক রদবদল হয়েছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মতিন বলেন, নকল-বাণিজ্য বন্ধ করতেই এসব ভেন্যু কেন্দ্র বাতিল করেছি।