Image description

স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদপণ্যসহ অন্তত সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত, যা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) শনিবার এই নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করে।

সেখানে বলা হয়, কোনো স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের পোশাক পণ্য ভারতে ঢুকতে পারবে না।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখন থেকে কেবল কলকাতা ও মুম্বাইয়ের নভসেবা (জওহরলাল নেহরু) সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে।

ফল, ফলের-স্বাদযুক্ত পানীয় ও কার্বোনেটেড ড্রিংকস; বেকারি, চিপস, স্ল্যাকস এবং কনফেকশনারিতে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাবার; তুলা ও সুতার ঝুট; পিভিসিসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য এবং কাঠের তৈরি আসবাবপত্রও বিধিনিষেধের আওতায় পড়েছে।

আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের কোনও ‘ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন’ বা ‘ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট’ (আইসিপি) দিয়ে এবং পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন দিয়ে এসব পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে পারবে না।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের এক মাসের মাথায় ভারতের এই পাল্টা নিষেধাজ্ঞা এল, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করার কথা বলেছে দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

তবে বাংলাদেশ থেকে মাছ, এলপিজি, ভোজ্যতেল ও পাথর আমদানি অব্যাহত রাখছে ভারত। এছাড়া ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল কিংবা ভুটানে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিও অব্যাহত থাকবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর যে চড়া শুল্ক আরোপ করেছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত তার চেয়েও কঠোর পদক্ষেপ নিল।

বিজিএমইএ এর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন সমুদ্রপথে ভারতের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পণ্য পাঠাতে গেলে আগের থেকে আরো বেশি সময় লাগবে, খরচও বাড়বে। তার মানে এক্সপোর্ট কিছুটা হলেও কমার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাব।”

বিশেষ করে ছোট রপ্তানিকারকরা এই নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশি সমস্যায় পড়বেন, কারণ অল্প পরিমাণ পণ্য সমুদ্রপথে পাঠাতে গেলে তা লাভজনক হয় না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের-এনবিআর তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৭ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার পণ্য ভারতে রপ্তানি করে; গত অর্থবছরে তা প্রায় অপরিবর্তিত ছিল।

অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেছে ১৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার পণ্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে রপ্তানি হয়েছে ১১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকার পণ্য।

যেসব দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে, তার মধ্যে ভারত একটি, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৭০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।

এর মধ্যে ৯৩ শতাংশের মত পোশাক পণ্য স্থলপথেই রপ্তানি হয়। ফলে ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা এ খাতের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দেখা দেবে বলে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা।

ভারতের ইংরেজি পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড লিখেছে, ভারতের এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য টানাপোড়েন আরও তীব্র আকার ধারণ করল।

প্রায় এক মাস আগে ভারত থেকে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুযোগ বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর।

অন্যদিকে গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে ভারত। এখন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরো কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করল প্রতিবেশী দেশটি।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের ১১টি স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য হয়। এগুলোর মধ্যে আসামে তিনটি, মেঘালয়ে দুটি ও ত্রিপুরায় ছয়টি বন্দর রয়েছে।

ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি গত কয়েক বছর ধরে বাড়ছিল। এখন ওই এলাকার সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা করাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন যদি দিল্লি বা অন্য কোনো সমুদ্র বন্দর দিয়ে রপ্তানি করতে হয়, তাহলে পরিবহন খরচ বাড়বে। কারণটা হল, স্থল পথ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে দূরত্ব কম। যে কোনো ছোটো আকারের, ধরেন এক ট্র্যাক পণ্যও পাঠানো যায়। কিন্তু সমুদ্র পথে তা সম্ভব না, খরচ বেড়ে যাবে।

“আবার সমুদ্র থেকে পণ্য নামিয়ে আবার ট্রাকে নিয়ে সেভেন সিস্টার্সে গেলে অনেক খরচ বাড়বে। এই দামে পণ্য বিক্রি কতটা বাড়বে এখন পাঠানোর পর বোঝা যাবে।”

তৈরি পোশাক খাত নিয়ে শামস মাহমুদের পর্যবেক্ষণ হল, বাংলাদেশ থেকে মাঝারি আকারের কারখানাগুলো ভারতে কিছু পোশাক পাঠায়, সেগুলো বাধাগ্রস্ত হবে।

আর ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেলের ভাষায়, ভারতের এ পদক্ষেপ ‘হঠকারী’হল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এমন সিদ্ধান্ত স্বভাবতই দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাবে। বিশ্ব বাণিজ্য যখন বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত, ঠিক তখন এ ধরনের পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্ত দুই দেশের জন্যই ক্ষতির মাত্রা বাড়াবে।”

ভারতের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি যেখানে দিন দিন বাড়ছে, সেখানে নতুন সিদ্ধান্ত ‘একটু হলেও চিন্তার কারণ হবে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রুবেল বলেন, “সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়িক সম্পর্কে এফেক্ট ফেলবে, সেই আশঙ্কা তো থেকেই যায়।”

শাসা ডেনিমস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, “স্থলপথের বাণিজ্যে দুই দেশের লাভ ছিল। সেদেশের জনগণ কম খরচে বাংলাদেশের পণ্য পেত। কিছু পণ্য তো ভারতও (পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে) পাঠাতে পারে না।

“এখন এই বাজারকে ঘিরে যেসব বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হতে পারে। আমার মনে হয়, এটি দীর্ঘদিন থাকবে না। দুই দেশকে আবার ভাবতে হবে সমাধান নিয়ে।”

কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ভারত হঠাৎ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল, তা স্পষ্ট হচ্ছে না বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের কাছে।

তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে আগে কোনো কথা শোনা যায় নাই। কোনোরকম আলাপ আলোচনা তো হয় নাই। ভারত তো কোনো কারণও দেখয়নি। এসব ক্ষেত্রে একটা কারণ তো দেখাতে হয়, নয়ত ডব্লিউটিও কমপ্লায়েন্সের ইস্যু আসবে।”

জাহিদ হোসেন বলেন, “আমার ধারণা ওরা দেখাবে সিকিউরিটি গ্রাউন্ড। না হলে স্থলপথ দিয়ে এখন এটা (নিষেধাজ্ঞা) কেন। এটা তো আবার একটা হাস্যকর গ্রাউন্ড না? এই বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর ধরে। এমন কী ঘটনা ঘটছে যার ভিত্তিতে আপনি বলতে পারেন বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ার এক্সপোর্ট একটা সিকিউরিটি কনসার্ন?”