
কবির নামেই যার আত্মপ্রকাশ, তার পরতে পরতে যেন কবির ছায়া থাকবেই—এটাই তো স্বাভাবিক। তেমনই এক ব্যতিক্রমী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালের মাটিতে গড়ে ওঠা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দেয়ালে, পথে, পাঠশালায়, এমনকি প্রতিটি আড্ডায় মিশে আছে এক অনন্য সাহসী কণ্ঠস্বর—নজরুল। তার বিদ্রোহ, প্রেম, মানবতা, সাম্যবাদ ও সংগ্রামী চেতনা এখানে শুধু পাঠ্যবিষয় নয়, বরং জীবনের প্রতিদিনের অনুশীলন।

এই ক্যাম্পাস যেন শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়—একটি চিন্তার কেন্দ্র, একটি সংস্কৃতির নীড়, আর কবি নজরুলের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে চলা এক স্বপ্নযাত্রা। এখানকার প্রতিটি নিঃশ্বাসেই যেন উচ্চারিত হয়—‘আমি চিরবিদ্রোহী বীর।’ এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিয়ে আজকের আয়োজন। লিখেছেন শাহ বিলিয়া জুলফিকার।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর প্রায় তিন দশক পর ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার নামাপাড়া গ্রামে গড়ে ওঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৪-১৫ সালে নজরুল তার বর্ণাঢ্য জীবনের একটি বছর কাটিয়েছিলেন ত্রিশালের এই নামাপাড়ায়। এখানকার একটি প্রাচীন বটগাছের নিচে বসে তিনি বাঁশি বাজাতেন। সেই স্মৃতিবিজড়িত বটগাছের পাশেই, শুকনি বিলের মাঝে, প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিদ্যাপীঠ।
ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ৫৭ একরজুড়ে বিস্তৃত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে দুই শতাধিক শিক্ষক সাত হাজার পাঁচশ’র বেশি শিক্ষার্থীকে পাঠদান করছেন।
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের ২১তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আজ ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে সুপরিচিত। বর্তমানে এখানে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২৫টি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। শিক্ষার্থীরা এখানে আইন, নাট্যকলা, চারুকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও সাহিত্য ছাড়াও বিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন।
যে বৃক্ষকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশালে থাকাকালে একটি বটগাছ ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অতি প্রিয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানে বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে কবির বহু দ্বিপ্রহর কেটেছে। পাশেই ছিল শুকনি বিল, যেখানে তিনি সহস্র হংস-শারি ও চখা-চখির মিলনমেলা দেখতেন, যার চিত্র আছে তার রচনায় ও গানে। মনোমুগ্ধকর সে পরিবেশে নজরুল উচ্ছ্বসিত হতেন। পাগলের মতো বাঁশি বাজাতেন। বলতেন, আমি ভগীরথ পাখি নামাচ্ছি, আমি হামিলটনের জাদুকর। বটগাছটি ছিল বিলের ধারে। প্রিয় সে বটগাছটির একটি প্রশস্ত ডালে বসে পা প্রসারিত করে অন্য একটি মোটা ডালে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজাতেন । আজ সে শুকনি বিল নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে মানববসতি। আর সে শুকনি বিলে বটগাছের পাশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালে সেই শুকনি বিলের বটগাছের পাশে নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অবস্থিত, সেই জায়গা একসময় বটতলা নামেই পরিচিত ছিল। ক্যাম্পাসের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে এটি আড্ডার অন্যতম প্রিয় জায়গা। শুধু ক্যাম্পাস নয়, এর বাইরেও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কৌতূহলী মানুষেরা নজরুল স্মৃতি অবলোকন করতে ছুটে আসেন ত্রিশালে, সময় কাটান নজরুল বৃক্ষে।
দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তারিফুল ইসলাম স্যার জানান, কবি নজরুলের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত স্থান এবং বিশেষ করে এই বটবৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের সঙ্গে এবং নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই এখানে বসা হয়। আড্ডা-গল্পে সময় কাটাই। ক্যাম্পাসের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বটতলা তথা নজরুল বটবৃক্ষ। চায়ের দোকানটিকে কেন্দ্র করে বটতলাটি রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত প্রাণচঞ্চল থাকে। বটতলার এই চায়ের দোকানটি যেদিন বন্ধ থাকে, সেদিন কেমন যেন একটা শূন্যতা মনে হয়। নজরুলের বাঁশির সুর যে গাছের নিচে বেজেছিল, স্মৃতি আঁকড়ে সেটি হাজার বছর বেঁচে থাকুক এবং নজরুল বেঁচে থাকুক আমাদের হৃদয়ে, কর্মে ও আদর্শে।
সেখানে গল্প-আড্ডায় শুধু শিক্ষকরাই থাকেন না, আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও নানা পেশার মানুষ। নজরুল বটবৃক্ষের উৎসবমুখর এ পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুম জানান, ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বটবৃক্ষের তলায় চা-আড্ডায় মেতে ওঠেন। জায়গাটি প্রতিনিয়ত সংস্কৃতিচর্চার অংশ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করছে। একই সঙ্গে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বটবৃক্ষটি। প্রায়ই ক্লাসের ফাঁকে সান্ধ্য আড্ডা কিংবা গান-বাজনায় মেতে উঠি সবাই। ক্যাম্পাসের চিরচেনা জায়গা এটি।
শুধু ক্যাম্পাসের নয়, বাইরের যে কেউ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা নজরুল স্মৃতিতে ঘুরতে এলে নজরুল বটবৃক্ষে আড্ডায় বসেন। আর উৎসবমুখর পরিবেশ দেখে আপ্লুত হন। এ নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজিদ জানান, ‘নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার মধ্য দিয়ে সুন্দর কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে। একটা ক্যাম্পাসে সবাই সবার এত আপন, এত কাছের, এত পরিচিত হতে পারে, তা আমার আগে জানা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচে-কানাচে শিক্ষার্থীদের কোলাহল যেন আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে নজরুল বটবৃক্ষে আড্ডার সময়টা মনে রাখার মতো। যে গাছের কথা সবসময় শুনতাম, তা দেখে খুব ভালো লেগেছে।’

নজরুল স্মৃতিতে জীবন্ত
স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে আছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম—বাংলাদেশের বিদ্রোহী আত্মার প্রতীক। তার নামেই প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’ শুধু একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি চেতনার কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে সাহিত্যে, সংগীতে ও মানবতাবোধে কবির আদর্শ জীবন্ত থাকে। এই বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের মাঝে নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতা, বিদ্রোহ, প্রেম ও মানবতার বাণী ছড়িয়ে দেয়। প্রতিটি প্রাঙ্গণ, প্রতিটি পাঠদান যেন কবির স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন—নজরুলের স্মৃতিকে ধারণ করে এগিয়ে চলছে এক নতুন আলোর পথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল সিফাত বলেন, ‘নজরুল শুধু একজন কবি নন, তিনি আমাদের চিন্তা ও চেতনার অনুপ্রেরণা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে আমি গর্বিত। এখানে প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ক্লাসরুম যেন কবির বিদ্রোহী চেতনার এক এক জীবন্ত স্মারক। আমরা শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান গ্রহণ করি না, নজরুলের মতো মানুষ হয়ে ওঠার স্বপ্নও দেখি। তার অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা, ও সাহিত্যিক শক্তি আমাদের নিত্যদিনের প্রেরণা। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের শেখায় কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কিছু করতে হয়।’
স্থাপনা ও ম্যুরাল
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়—নামেই নয়, সত্তাতেই কবি নজরুলের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এই বিদ্যাপীঠ যেন একটি বিস্তৃত কবিতার পৃষ্ঠা, যেখানে প্রতিটি স্থাপনা, প্রতিটি নামকরণ কবির সাহিত্য থেকে উঠে এসেছে গভীর মমতায়। উপাচার্যের বাসভবনের নাম ‘দুখু মিয়া’—যেন কবির শৈশবই আশ্রয় নিয়েছে এক শান্ত প্রাঙ্গণে। তার ফটকে, প্রশাসনিক ভবনের সামনে স্থাপিত নজরুল ম্যুরাল যেন প্রতিবিম্বিত করে কবির দ্রোহী ও মানবিক চেতনাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত নজরুল ভাস্কর্যটি যেন কবিতার একটি অক্ষর—নিস্তব্ধ অথচ গভীরভাবে বাগ্মী। শহীদদের স্মরণে নির্মিত ‘চির-উন্নত মম শির’ স্মৃতিস্তম্ভ শুধু একখণ্ড পাথর নয়, এটি এক চিরকালীন উচ্চারণ, বিদ্রোহের চেতনায় গড়া আত্মমর্যাদার স্তম্ভ। আবাসিক হলগুলোর নাম ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিদ্রোহী’, ‘দোলনচাঁপা’ ও শিউলিমালা—কবির কাব্যগ্রন্থের অনুরণনে গড়া, যেন প্রতিটি ঘুম আর জাগরণে কবির সুর বাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার ‘ব্যথার দান’ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে দুটি ক্যাফেটেরিয়া, যা ‘চক্রবাক’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’র নামে দুটো গ্রন্থের নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র গেস্ট হাউসের নামকরণ করা হয়েছে নজরুলের লেখা একটি একাঙ্ক নাটক ‘সেতু-বন্ধ’-এর নামানুসারে। এই নামগুলো যেন সাহিত্য ও বাস্তবতার সেতুবন্ধ, যেখান থেকে শুরু হয় এক অনন্য শিক্ষাজীবন। তা ছাড়া সম্প্রতি চালু হয়েছে ‘বুলবুল শিশুপার্ক’।
সাংস্কৃতিক চেতনায় নজরুলের ছায়া
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় ‘গাহি সাম্যের গান মুক্তমঞ্চ’, ‘চুরুলিয়া মঞ্চ’ ও ‘জয়ধ্বনি মঞ্চ’-এ। এর মধ্যে ‘গাহি সাম্যের গান’ ও ‘জয়ধ্বনি’—দুটি শব্দই নেওয়া হয়েছে কবি নজরুল ইসলামের কালজয়ী কবিতা থেকে। এই নামকরণ শুধু শৈল্পিক সৌন্দর্য নয়, বরং নজরুলের ভাবনাকে সাংস্কৃতিক পরিসরে জীবন্ত করে রাখার এক সুসংগঠিত প্রয়াস।
বৃত্তি ও গ্রন্থাগারে নজরুল
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য চালু থাকা বৃত্তিগুলোর নামকরণও করা হয়েছে কবির পরিবারের সদস্যদের নামে; যেমন ‘প্রমীলা বৃত্তি’, ‘বুলবুল বৃত্তি’ ও ‘কাজী অনিরুদ্ধ বৃত্তি’। এসব বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেমন আর্থিক সহায়তা পান, তেমনি তারা যুক্ত হন নজরুল পরিবারের স্মৃতির সঙ্গে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে রয়েছে নজরুল কর্নার, যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে তার গল্প, উপন্যাস, জীবনীসহ বিপুল সাহিত্যভাণ্ডার, যা ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক অনন্য পাঠের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
পাঠ, গবেষণা ও পদকে জীবন্ত নজরুল
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হয় ১০০ নম্বরের ‘নজরুল স্টাডিজ’ কোর্স, যাতে ছাত্রছাত্রীরা কবিকে জানার মৌলিক সুযোগ পান। নজরুলের সাহিত্য, জীবন ও দর্শনের ওপর উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ’। এই প্রতিষ্ঠানে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামের মাধ্যমে চলমান রয়েছে নজরুলের গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও জীবনকর্ম নিয়ে গভীর গবেষণা। প্রতিবছর কবির জন্মজয়ন্তীতে আয়োজিত হয় আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ আয়োজনে নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণ ও গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয় ‘নজরুল পদক’, যা তুলে দেওয়া হয় দেশ-বিদেশের গুণী গবেষক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে।
যাত্রাপথেও নজরুলের স্পর্শ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাসগুলোর নামকরণেও রয়েছে কবির সাহিত্যকর্মের ছায়া। ক্যাম্পাস থেকে ময়মনসিংহ ও ভালুকাগামী প্রতিদিন চলাচলকারী বাসগুলোর নাম—‘বিদ্রোহী’, ‘ধূমকেতু’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘প্রভাতী’, ‘বাঁধনহারা’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘দক্ষিণ হাওয়া’, ‘সওগাত’, ‘সাম্যবাদী’ ইত্যাদি সবই নজরুলের কবিতা, গল্প বা প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। শুধু যাতায়াতের বাহন নয়, এসব নাম যেন শিক্ষার্থীদের যাত্রাপথেও ছড়িয়ে রাখে কবির চেতনা ও সাহসের দীপ্তি।

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বদলে যাচ্ছে
বর্তমানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে উন্নয়নের এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। ক্যাম্পাসের প্রতিটি কোণেই চোখে পড়ে নির্মাণযজ্ঞের ব্যস্ততা। একাধিক অ্যাকাডেমিক ও ইনস্টিটিউট ভবন, আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষ, আইটি স্পেস, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসিক ভবন, অতিথিশালা, মাল্টিপারপাস হল, চিকিৎসা কেন্দ্র, মসজিদ—সবকিছুই উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। নতুন অ্যাকাডেমিক ভবনে থাকছে আধুনিক অডিটোরিয়াম, যেখানে সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও ট্রেনিংয়ের আয়োজন করা যাবে নিয়মিতভাবে।
ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য চারপাশে সবুজবেষ্টনী তৈরি, খেলার মাঠ উন্নয়ন (ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, বাস্কেটবল কোর্ট), বৃক্ষরোপণ, জলাশয় ঘিরে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, আরসিসি অভ্যন্তরীণ রাস্তা, পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন, কালভার্ট ও দৃষ্টিনন্দন দুটি গেট নির্মাণসহ চলছে বিভিন্ন পরিকাঠামোগত উন্নয়ন।
উপাচার্য ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নজরুলচর্চায় গুরুত্ব দিয়ে আসছে। অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে নজরুল সৃষ্টিকর্ম দেশ-বিদেশে প্রসারিত করছে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে ১০০ নম্বরের ‘নজরুল-স্টাডিজ’ কোর্স স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোয় এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে উচ্চতর গবেষণার দ্বার উন্মোচন করা হয়েছে।
এ ছাড়া নজরুলের জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ। এই ইনস্টিটিউট থেকে নজরুল-বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ, জার্নাল, সেমিনার, কনফারেন্স, গবেষণা প্রকল্প ও বৃত্তি প্রদান করা হয়। ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম হিসেবে নজরুলের জীবন ও কর্মের ওপর এমফিল কোর্স চালু করা হয়েছে এবং নিকট ভবিষ্যতে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। গবেষণা কার্যক্রম পরিধি বিস্তারে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, আসানসোল, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ও ফেরদৌসি ইউনিভার্সিটি অব মাসআদের সঙ্গে নজরুল-বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় গবেষণা চুক্তি হয়েছে, যার মাধ্যমে সেমিনার, কনফারেন্স ও জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সমৃদ্ধি নির্মাণে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অবিস্মরণীয় এবং তা আমাদের জীবনের উত্তরোত্তর বিকাশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। শুধু অ্যাকাডেমিক কিংবা গবেষণা কার্যক্রমই নয়, আমাদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনসহ বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ হয়েছে নজরুলের জীবন সাহিত্য থেকে; যেমন অগ্নিবীণা হল, দোলনচাঁপা হল, বিদ্রোহী হল, শিউলীমালা হল, ব্যথার দান মেডিকেল সেন্টার, দুখুমিয়া বাংলো, সেতুবন্ধ গেস্ট হাউস, গাহি সাম্যের গান মঞ্চ, নজরুল ভাস্কর্য, বিভিন্ন কাব্যের নামে পরিবহন এবং নজরুলসংগীত ও নাট্যচর্চার মুক্ত পরিবেশ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়কে করেছে নজরুলময়, গড়ে উঠেছে নজরুল-তীর্থরূপে।